বিরূপ পরিবেশ ও খাদ্য সংকটে বিলুপ্তির পথে

সরকার শকুন রক্ষায় পশুচিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেনজাতীয় ওষুধ ২০২১ সাল থেকে নিষিদ্ধ করেছে।

হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বনে গাছের ডালে শকুন

তিন দশক আগেও গ্রামগঞ্জের যেখানে-সেখানে শকুনের দেখা মিলত। ঝাঁক বেঁধে শকুনকে মরা গরু খেতে দেখা যেত। এ দৃশ্য এখন বিরল। প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতা প্রাণী হিসেবে পরিচিত এ প্রাণী এখন বিলুপ্তির পথে।

আজ শনিবার আন্তর্জাতিক শকুন দিবস। সারা দেশে শকুনের প্রজননহার অপরিবর্তিত থাকলেও হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বনে প্রজননহার বেড়েছে। এটাকে আশার আলো হিসেবে দেখছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

রেমা-কালেঙ্গা বনে শকুনের প্রজননহার বেড়েছে। ২০১৪ সালে এ অঞ্চলে প্রজননহার ছিল ৪৪ শতাংশ, এখন তা ৭১ শতাংশ।
সারোয়ার আলম, প্রকল্প পরিচালক, আইইউসিএন

শকুন বাঁচাতে সচেতনতা গড়ে তুলতে প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের প্রথম শনিবার পালন করা হয় ‘আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস’। বন বিভাগের সুফল প্রকল্পের অধীন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) নামে একটি প্রতিষ্ঠান দেশে ২০১৪ সাল থেকে শকুনের পরিচর্যা নিয়ে কাজ করছে।

গবেষকেরা বলছেন, বিরূপ পরিবেশ, নিরাপত্তার অভাব ও খাদ্যসংকটে শকুন বিলুপ্তির পথে। পাশাপাশি পশুচিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেনজাতীয় ওষুধের ব্যবহারও শকুন বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ। কারণ, এসব ওষুধ ব্যবহারের ফলে যে পশু মারা যায়, সেগুলো শকুন হজম করতে পারে না। ফলে ওই পশু খাওয়ার এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে মারা যায় শকুন। তাই সরকার পশুচিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেনজাতীয় ওষুধ ২০২১ সাল থেকে নিষিদ্ধ করেছে।

আইইউসিএন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুয়ায়ী বাংলাদেশে ২৬০টি শকুন আছে। একসময় দেশে সাত রকমের শকুন দেখা যেত। এখন মাত্র বাংলা শকুনকে দেখা যায়। এ শকুনের জন্য দুটি স্থানকে নিরাপদ আবাসস্থল বলা হয়। তার একটি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল রেমা-কালেঙ্গা এবং অপরটি খুলনার সুন্দরবন। ২৬০টি শকুনের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০টি শকুন রেমা–কালেঙ্গায় রয়েছে। ২০১৪ সালে যখন আইইউসিএন কাজ শুরু করে, তখন রেমা-কালেঙ্গা বনে শকুনের প্রজননহার ছিল ৪৪ শতাংশ। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭১ শতাংশ।

এ অঞ্চলকে শকুন বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে গবেষকেরা বলছেন, শকুন সাধারণ আবাস গড়ে তুলতে বড় গাছগাছালি বেছে নেয়। বিশেষ করে গর্জন ও বনাকগাছ তাদের পছন্দ। রেমা–কালেঙ্গায় এ ধরনের গাছগাছালি থাকায় শকুন নিরাপদ স্থান হিসেবে ওই স্থানকে বেছে নিয়েছে। শকুন শীত মৌসুমে প্রজনন বৃদ্ধি করে। ঠিক তখনই রেমা-কালেঙ্গা বনে শকুনের আনাগোনা একটু বাড়ে। এ শকুনগুলোকে মানুষের উপদ্রব থেকে বাঁচাতে ও নিরাপত্তা দিতে কাজ করে আইইউসিএন। শীত মৌসুমে শকুন আবাস গড়ে তোলে বনে, তখন গরু জবাই করে এ শকুনগুলোকে খাওয়াতে দেখা যায় আইইউসিএনকে।

আইইউসিএনের অধীন কাজ করেন গবেষক মাহী ওয়াইসি। তিনি গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, শকুন প্রাকৃতিকভাবে পৃথিবীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা বর্জ্যভুক প্রাণী। এটি শুধু প্রকৃতিকে পরিষ্কারই রাখে না, জীবাণুমুক্তও রাখে। অ্যানথ্রাক্সের মতো ভাইরাস খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে এ শকুন। শকুন বাঁচাতে এর বংশবৃদ্ধির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ খুব জরুরি।

আইইউসিএনের প্রকল্প পরিচালক সারোয়ার আলম গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলা শকুন রক্ষায় ২০১৪ সাল থেকে হবিগঞ্জ ও খুলনায় কাজ করছি। এ–জাতীয় শকুন পুরো পৃথিবীতেই একেবারে কমে গেছে। তবে এ দেশে অপরিবর্তিত আছে এর পরিসংখ্যান। আশার আলো হলো, রেমা-কালেঙ্গা বনে শকুনের প্রজননহার বেড়েছে। আমরা যখন ২০১৪ সালে কাজ শুরু করি, তখন এ অঞ্চলে প্রজননহার ছিল ৪৪ শতাংশ, এখন তা ৭১ শতাংশ। আগামী ডিসেম্বর মাসে শকুনের শুমারি শেষ হলে, তখন জানা যাবে দেশে শকুনের সঠিক পরিসংখ্যান।’

সারোয়ার আলম আরও বলেন, রেমা-কালেঙ্গা বনাঞ্চল ও খুলনার সুন্দরবনকে সরকার শকুনের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল ঘোষণা করেছে। আরও ভালো খবর, সরকার দেশে গরুতে কিটোপ্রোফেনজাতীয় ক্ষতিকর ওষুধ প্রয়োগ নিষিদ্ধ করেছে। এতে শকুনকে রক্ষা করা যাবে।