পরিবারসহ এখনো বাড়ি ফিরতে পারেননি কাঁঠালতলী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য অঞ্জন ভট্টাচার্য এবং একই ইউনিয়নের বাসিন্দা সুজন রায়।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় গত ৫ আগস্ট বা পরে হামলা ও লুটপাটের শিকার ১০টি সংখ্যালঘু পরিবারের অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারেননি। কোনো পরিবারের প্রধান বাড়িছাড়া আবার কোনো পরিবারের সবাই এলাকাছাড়া। বাড়ি ফিরতে বিএনপির নেতারা চাঁদা দাবি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। যদিও বিএনপির নেতারা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
সরেজমিনে জানা যায়, পুরো পরিবারসহ এখনো বাড়ি ফিরতে পারেননি পাথরঘাটার কাঁঠালতলী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য অঞ্জন ভট্টাচার্য এবং একই ইউনিয়নের বাসিন্দা সুজন রায়। তালুকের চরদুয়ানি গ্রামের অর্জুন হাওলাদার, শৈলেন হাওলাদার ও দেবাশীষ সেনগুপ্তের পরিবার এলাকায় থাকলেও তাঁরা পালিয়ে আছেন।
পাথরঘাটা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক চৌধুরী মোহাম্মদ ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি শুনেছি, এমাদুল খান নামের এক ব্যক্তি সংখ্যালঘুদের কাছে টাকা চাচ্ছেন। ওই ব্যক্তি উপজেলা বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। ইউনিয়ন পর্যায়ের কোনো পদে থাকতে পারেন। বিএনপি কখনোই সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করে না। কেউ যদি ব্যক্তিস্বার্থের জন্য বিএনপিকে ব্যবহার করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পাথরঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলায় বেশ কয়েকটি সংখ্যালঘু পরিবারে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে।
বরগুনার পুলিশ সুপার মো. ইব্রাহিম খলিল প্রথম আলোকে বলেন, টাকা চাওয়ার বিষয়টি তাঁর জানা নেই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন কমিটির বরগুনা জেলা শাখার সদস্যসচিব জয়দেব রায় প্রথম আলোকে জানান, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বরগুনায় ৩০টি ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৬টি, পাথরঘাটায় ১০টি, তালতলীতে ৩টি, আমতলীতে ৮টি, বেতাগীতে ২টি ও বামনা উপজেলায় ১টি।
পাথরঘাটার কাঁঠালতলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য অঞ্জন ভট্টাচার্যের বাড়িতে ৬ আগস্ট হামলা হয়। পরদিন সপরিবারে বাড়ি ছেড়ে চলে যান তিনি। এখন পর্যন্ত ফিরতে পারেননি। অঞ্জন ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার পতনের পরের দিন বিএনপির লোকজন আমার বাড়িতে হামলা চালায়। তারা আমার দোকান ভাঙচুর করে দখল করে। আমার মোটরসাইকেলটি নিয়ে গেছে। তাদের ভয়ে আমি পরিবার নিয়ে বাড়ি ছেড়েছি। আমার জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই।’
একই ইউনিয়নের বাসিন্দা সুজন রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাড়িতে কিছুই নেই, সব ওরা নিয়ে গেছে। এখনো হুমকি দেয়, টাকাপয়সা চায়। আমি এখন কোথাও যেতে পারি না। আমাকে ধরে নিয়ে মারছে, আমি এখন হাঁটতে পারি না। আমার পায়ের গিঁটে টাকাইছে।
জানতে চাইলে সুজন রায় আরও প্রথম আলোকে বলেন, আমি খুলনায় ডাক্তার দেখাইছি, এখন পর্যন্ত ঠিক হয়নি। আমাকে এমাদুল খান, ফোরকান, মাসুম বিল্লাহসহ বেশ কয়েকজন বেধড়ক মারধর করে।’
তালুকের চরদুয়ানি এলাকার বাসিন্দা অর্জুন হাওলাদারের স্ত্রী মনি রানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার পতনের দিন বিকেলে আমাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করে মালামাল লুটপাট করা হয়। সেই থেকে আমার স্বামী বাড়িছাড়া। বিএনপির নেতা এমাদুল খানসহ কয়েকজন আমাদের বাড়িতে এসে এক লাখ টাকা দাবি করেন।’
অর্জুন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, টাকা দাবি করেন বিএনপির নেতা হাবিবুর রহমানের বাহিনীর লোক এমদাদুল খানসহ অনেকেই। এমাদুলও বিএনপি করেন। তাঁর বাবা হাবিব চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা বাবাকে হুমকি দিচ্ছেন।
অভিযোগের বিষয়ে কাঁঠালতলী ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক প্রচার সম্পাদক ও পাথরঘাটা উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য এমাদুল খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কোনো টাকা চাইনি। আমার নামে এসব মিথ্যা বলা হচ্ছে। আমি ওই বাড়িতে পান খেতে গিয়েছিলাম। শুধু সুজন রায় নামের এক ব্যক্তিকে মারধর করেছিলাম। কারণ, তারা আওয়ামী লীগের সময় আমাকেও মারধর করেছিল।’
পাথরঘাটা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও কাঁঠালতলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন স্থানে কমবেশি মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এ রকম ঘটনা সারা বাংলাদেশে ঘটেছে। বিষয়টি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।’
সুজন রায়কে আপনার উপস্থিতিতে মারধর করা হয়েছে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক নয়। তাকে উদ্ধার করে আমি আমার গাড়িতে করে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
জেলা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক হাসানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের ওপর এমন হামলার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। ২০০১ সালেও এমন ঘটনা ঘটেছিল পাথরঘাটায়।