‘আমার আব্বুর কী দোষ ছিল? আব্বু শারীরিকভাবে অসুস্থ। সংঘর্ষ দেখে দোকান বন্ধ করে তিনি বাসায় ফিরছিলেন। বারবার দুই হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়ে আকুতি করেছিলেন। তিনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না, স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতেও পারেন না। অসুস্থ বলা সত্ত্বেও তাঁকে কেন গুলি করে মারল? আমার আব্বুরে এখন কই পাব?’
কথাগুলো বলছিলেন ২০ জুলাই ঢাকার সাভার বাসস্ট্যান্ডে গুলিতে নিহত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কুরমান শেখের (৪৯) মেয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিতু আক্তার। গতকাল রোববার রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া রেললাইনের পাশে চাচা ছাত্তার শেখের বাসায় কথা হয় মিতুর সঙ্গে। মিতুর বাবা নিহত কুরমান শেখ কালুখালী উপজেলার পূর্ব রতনদিয়া গ্রামের বাসিন্দা।
কুরমান শেখের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, কালুখালীর রতনদিয়া রেললাইনের পাশে জরাজীর্ণ টিনের ঘর ছাড়া তাঁর কোনো সম্পদ নেই। দেড় দশক ধরে ঢাকার সাভার বাসস্ট্যান্ডে একটি ছোট্ট ঘরে দৈনিক ভাড়া ভিত্তিতে মুরগির ব্যবসা করতেন। সাভার মাছবাজারের পেছনে ভাড়া বাসায় স্ত্রী শিল্পী খাতুন, ছেলে রমজান শেখ ও মেয়ে মিতু আক্তারকে নিয়ে বাস করতেন তিনি।
ছেলে রমজান শেখ (২২) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকপ্রশাসন বিভাগের চতুর্থ বর্ষে ও মেয়ে মিতু আক্তার (২০) ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন।
মিতু আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০ জুলাই দুপুর ১২টার পর থেকে সাভার বাসস্ট্যান্ডে গোলাগুলির আওয়াজ পেয়ে ভয় পাই। পৌনে একটার দিকে বাবাকে ফোন করে দ্রুত বাসায় আসতে বলি। বাবা শুধু জানায়, “অবস্থা ভালো না, দোকান বন্ধ করে আসছি।” এই ছিল আব্বুর সঙ্গে আমার শেষকথা। আব্বু তো বাসায় ফিরছিল। তাহলে কেন গুলি করে মারল? আমার আব্বু অসুস্থ মানুষ।’
নিহত কুরমান শেখের স্ত্রী শিল্পী খাতুন বলেন, ‘সে প্রতিবন্ধী ভাতাও পেত। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না, ঠিকমতো হাঁটতেও পারত না। ছেলেকে বিসিএস ক্যাডার এবং মেয়েকে ব্যাংকার বানাবে বলে অনেক কষ্ট করত। সে কোনো দল করত না। আমার স্বামী হাতজোড় করে পুলিশের কাছে বলছিল, “স্যার, আমি অসুস্থ, ব্যবসা করে খাই, আমারে গুলি কইরেন না।”এরপর কেন গুলি করে মারল? দুই ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় ভালো বলে অনেক কষ্ট করত। আমার ছেলেমেয়ের দায়িত্ব কে নেবে। কীভাবে পড়াশোনার খরচ চালাব। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।’
সংঘর্ষের দিন সাভার এলাকায় অনেকের দেখাদেখি কুরমান শেখ দোকান খুলেছিলেন বলে জানান ছেলে রমজান শেখ। তিনি বলেন, ‘দুপুরে সংঘর্ষ শুরু হলে আব্বু দোকান বন্ধ করে পেছনের মাছবাজার এলাকার বরফকলের ভেতরে আশ্রয় নেন। এ সময় অনেকে সেখানে আশ্রয় নেন। আমার এক চাচাও ছিলেন। পুলিশ হঠাৎ বাজারে ঢুকে বরফকলের কাছে এসেও গুলি শুরু করে। বেলা পৌনে দুইটার দিকে চাচা ফোনে জানান, আব্বুকে গুলি করেছে। এসে দেখি আব্বুকে রক্তাক্ত অবস্থায় কয়েকজন ধরে নিচ্ছেন। দ্রুত সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক জানান বেঁচে নেই। আব্বুর বুকের বাঁ দিকে ও ডান পায়ের হাঁটুর নিচে গুলি লাগে। মুখের বাঁ দিকে ছররা গুলির ক্ষত ছিল।’