বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ খোন্দকার কামাল হাসানের বিরুদ্ধে কলেজের বিভিন্ন তহবিল থেকে লাখ লাখ টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। অতিরিক্ত কর্মচারী দেখিয়ে অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী তহবিলের টাকা উত্তোলন, ভুয়া ব্যয় দেখিয়ে বিভিন্ন তহবিলের টাকা লোপাট করা হয়েছে। ম্যাগাজিন তহবিল থেকে ১০ মাসে ১১ লাখ টাকা তোলা হলেও এ সময়ে কোনো ম্যাগাজিনই প্রকাশিত হয়নি।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কলেজে নিজ নিজ খাতে ব্যয় মেটানোর জন্য ৩২টি তহবিল আছে। একসময় কলেজের সব ধরনের ফি শিক্ষার্থীরা কলেজের হিসাব নম্বরে সরাসরি ব্যাংকে জমা দিতেন। এখন অধিকাংশ ফি অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে জমা দিতে হয়। এজেন্ট ব্যাংকিং কর্তৃপক্ষের থেকে অর্থ বুঝে পাওয়ার পর খাতওয়ারি আলাদা ব্যাংক হিসাব নম্বরে জমা দেয় কলেজ প্রশাসন। দুই ধাপে লেনদেনের কারণে শিক্ষার্থীদের থেকে বিভিন্ন খাতে তোলা টাকার পুরোটা ব্যাংকে জমা হয় না।
খোন্দকার কামাল হাসান গত বছরের ১৫ নভেম্বর অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। গত ১০ মাসে কলেজের বিভিন্ন তহবিল থেকে তাঁর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলনের অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তার আগের অধ্যক্ষ শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে ১৫ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক।
খোন্দকার কামাল হাসান গত বছরের ১৫ নভেম্বর অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। গত ১০ মাসে কলেজের বিভিন্ন তহবিল থেকে তাঁর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলনের অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তার আগে কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন শাহজাহান আলী। প্রায় ৬ বছর দায়িত্বকালে বিভিন্ন খাত থেকে ১৫ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জানতে চাইলে অধ্যক্ষ খোন্দকার কামাল হোসেন বলেন, একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ছাড়া কোনো অর্থ ব্যয় হয় না। বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের জন্য আলাদা কমিটিও আছে। কলেজ তহবিল থেকে অর্থ লুটপাটের সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের থেকে আদায় করা ফি আইন ও বিধি মেনেই ব্যয় করা হয়।
কলেজ প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী ফি বাবদ ৬০০ টাকা করে আদায় করা হয়। সেই হিসাবে ২৯ হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে আদায়যোগ্য অর্থের পরিমাণ ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। কিন্তু অধ্যক্ষ নভেম্বরে দায়িত্ব নেওয়ার পর তহবিলের হিসাব নম্বরে জমা হয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ৭২ হাজার ৬৬ টাকা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বাকি টাকা ব্যাংকে জমা হয়নি।
কলেজ ও ব্যাংকের নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, আজিজুল হক কলেজের খণ্ডকালীন ১৫৭ জন কর্মচারীর মধ্যে ৮৬ জনের বেতন–ভাতা বিভিন্ন বিভাগ, মসজিদ, বাস, স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ বিভিন্ন তহবিল থেকে দেওয়া হয়। বাকি ৭১ জনের বেতন–ভাতা বাবদ প্রতি মাসে অত্যাবশ্যকীয় তহবিল থেকে ব্যয় হওয়ার কথা ৬ লাখ ৭২ হাজার ৪৫০ টাকা। সেই হিসাবে অধ্যক্ষ দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ৯ মাসে কর্মচারীদের বেতন–ভাতা বাবদ ৭৫ লাখ ৪৪ হাজার ১১০ টাকা ব্যয় হওয়ার কথা। কিন্তু আগস্ট পর্যন্ত তহবিল থেকে তোলা হয়েছে ৯৮ লাখ ১৭ হাজার ৭৭৮ টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসে অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী তহবিল থেকে সাড়ে ২২ লাখ টাকার বেশি তোলা হয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আদর্শ মানুষ গড়ার বাতিঘর। কিন্তু সেখানেই যদি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ লুটপাট হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা কী নৈতিক শিক্ষা নেবেন।মাসুদার রহমান, সভাপতি, সচেতন নাগরিক কমিটি, বগুড়া
টাকা উত্তোলনের নথি সংগ্রহ করে দেখা যায়, ৭১ জন কর্মচারীর জন্য বেতন–ভাতার জন্য প্রতি মাসে ৬ লাখ সাড়ে ৭২ হাজার টাকা তোলার কথা থাকলে ব্যাংক থেকে গড়ে প্রতি মাসে ৯ লাখ টাকা করে তোলা হয়েছে। কর্মচারীদের বেতনের জন্য গত বছরের ডিসেম্বরে ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৩৩০ টাকা, জানুয়ারিতে ৯ লাখ ১৮ হাজার ৭২৮ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫০ টাকা, মার্চে ঈদুল ফিতরের বোনাসসহ ১৭ লাখ ৯৫ হাজার ২৪০ টাকা, এপ্রিলে বৈশাখী ভাতাসহ ১০ লাখ ২৪ হাজার ৬১০ টাকা তোলা হয়েছে। নভেম্বরে অধ্যক্ষ কামাল হোসেন দায়িত্ব নেওয়ার সময় তহবিলে স্থিতি ছিল ৩৮ লাখ ৩৮ হাজার ৭৮২ টাকা। এরপর নতুন বছরে জমা হয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ৭২ হাজার ৬৬ টাকা। ৯ মাসে ৯৮ লাখ ১৭ হাজার ৭৭৮ টাকা বেতন–ভাতা উত্তোলনের পর এখন তহবিলে জমা আছে ৬২ লাখ ৯৩ হাজার ৭০ টাকা।
কর্মচারীদের তালিকা সংগ্রহ করে দেখা যায়, খণ্ডকালীন কর্মচারী ৭১ জন হলেও অত্যাবশ্যকীয় তহবিল থেকে প্রতি মাসে কাগজে-কলমে ৮০ জনের বেতন–ভাতা তোলা হয়েছে। তালিকায় থাকা অন্তত ৯ জনকে কলেজের অন্য তহবিল থেকে বেতন–ভাতা দেওয়ার তথ্য মিলেছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শিক্ষার্থীরা সেবা না পেলেও চিকিৎসা তহবিল থেকে একজন চিকিৎসক ও চারজন কর্মচারীর বেতন দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত তোরছা তাছনিম ও শাহী সুলতানা চিকিৎসা তহবিল থেকে বেতন নিলেও দুজনের নামে অত্যাবশ্যকীয় কর্মচারী তহবিল থেকেও বেতন–ভাতা উত্তোলন করা হচ্ছে।
নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, কলেজের বাসচালকের সহকারী গোলাম রসুল (ফুল বাবু), গ্রন্থাগারে কর্মরত তানজিলা খাতুন ও রেজাউল আলম, পুরাতন ভবনের ছাত্রীদের কমনরুমের কর্মচারী রেশমা খাতুন, ফখরুদ্দিন আবাসিক হলের বাবুর্চি মর্জিনা বেগম ও নাজমা বেগম এবং কর্মচারী ইনছান আলী প্রতি মাসে নিজ নিজ খাত থেকে বেতন–ভাতা পেলেও অত্যাবশ্যকীয় তহবিল থেকেও তাঁদের নামে বেতন–ভাতা তোলা হচ্ছে।
এ বিষয়ে অধ্যক্ষ খোন্দকার কামাল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, কলেজের অত্যাবশ্যকীয় তহবিল থেকে খণ্ডকালীন ৮০ জন কর্মচারীর বেতন দেওয়া হয়। একই কর্মচারীকে একাধিক তহবিল থেকে বেতন দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
কলেজ ও ব্যাংক সূত্র জানায়, বাস তহবিলের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিবছর ২৭৫ টাকা আদায় করা হয়। এক বছরে মোট আদায় হয় ৭৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। অধ্যক্ষ কামাল হাসান দায়িত্ব নেওয়ার সময় নভেম্বরে তহবিলে ছিল ১ কোটি ৩৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৪৪ টাকা। আগস্ট পর্যন্ত ব্যাংকে জমা হয়েছে ৫৬ লাখ ৪৯ হাজার ২১৩ টাকা। সেই হিসাবে তহবিলে থাকার কথা ১ কোটি ৮৯ লাখ ৭৮ হাজার ৫৭ টাকা। ব্যাংকে বর্তমানে আছে ১ কোটি ৪৪ লাখ ৭৬ হাজার ৩৯৩ টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসে বাস তহবিলের ব্যয় বাবদ ৪৫ লাখ ৮৪ টাকা তোলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, কলেজের শিক্ষার্থীদের চলাচলে বাস আছে ছয়টি। বাসগুলো কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বগুড়ার নন্দীগ্রাম, ধুনট-শেরপুর, দুপচাঁচিয়া, সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও শিবগঞ্জের পীরব রুটে সকাল–বিকেলে মোট ৬০৮ কিলোমিটার চলাচল করে। যানজটে অতিরিক্ত জ্বালানিসহ দৈনিক ১৩০ লিটারের মতো জ্বালানি লাগে বলে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা জানিয়েছেন। প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য ১০৯ টাকা ধরে দৈনিক জ্বালানি ব্যয় ১৪ হাজার ১৭০ টাকা।
গত ১০ মাসে কলেজে কোনো ম্যাগাজিন ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়নি। উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়নি। অথচ ম্যাগাজিন তহবিল থেকে ১০ মাসে ১১ লাখ ২৮ হাজার ২৩৮ টাকা তোলা হয়েছে।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, বর্তমান অধ্যক্ষ দায়িত্ব নেওয়ার পর আগস্ট পর্যন্ত ২৯০ দিনের মধ্যে ১৯৪ দিন পাঠদান বন্ধ ছিল। বাকি ৯৬ দিনে বাস খাতে জ্বালানি খরচ ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এ ছাড়া লুব্রিকেন্ট, রক্ষণাবেক্ষণসহ ৯ মাসে ব্যয় আরও ৪ লাখ টাকা। ছয়টি বাসের চালক ও সহকারী মিলে ১২ জনের বেতন–ভাতা বাবদ প্রতি মাসে ব্যয় ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪০০ টাকা। জুলাই পর্যন্ত ৯ মাসে চালক ও সহকারীর বেতন–ভাতা বাবদ ব্যয় ১৫ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮০ টাকা। সব মিলিয়ে বেতনসহ বাস তহবিল থেকে মোট ব্যয় হওয়ার কথা ৩২ লাখ ৯৯ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু গত ১০ মাসে ৫৬টি চেকের মাধ্যমে বাস তহবিল থেকে ৪৫ লাখ ৮৪ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। তহবিল থেকে অতিরিক্ত ১২ লাখ ৮৮৪ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অধ্যক্ষ খোন্দকার কামাল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এক দিন বাস চলাচলের জন্য গড়ে ২১৫ লিটার জ্বালানি খরচ হয়। এর বাইরে বাস তহবিল থেকে প্রতি মাসে অধ্যক্ষের মাইক্রোবাস চালকসহ ১৩ জন কর্মচারীর বেতনে ব্যয় হয় ১ লাখ ৪৫ হাজার ২০০ টাকা।
ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, একজন শিক্ষার্থী ম্যাগাজিন ফি বাবদ ৩০ এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতি ফি বাবদ ৩০ টাকা করে জমা দেন। শিক্ষার্থীদের থেকে বছরে দুই খাতে আদায় হয় ১৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বর্তমান অধ্যক্ষ দায়িত্ব নেওয়ার সময় তহবিলে স্থিতি ছিল ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৩৮৬ টাকা। গত ১০ মাসে এ তহবিলে জমা হয়েছে ১১ লাখ ২ হাজার ৮৪৯ টাকা। এ সময়ে কলেজে কোনো ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়নি। উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়নি। অথচ এ তহবিল থেকে ১০ মাসে ১১ লাখ ২৮ হাজার ২৩৮ টাকা তুলেছেন বর্তমান অধ্যক্ষ। বর্তমানে আছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৯৯৭ টাকা।
শিক্ষার্থী ও ব্যাংক সূত্র জানায়, একজন শিক্ষার্থীর থেকে বিবিধ ফি বাবদ বছরে ৮০ টাকা আদায় করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। সেই হিসাবে ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকা আদায় হওয়ার কথা থাকলেও আগস্ট পর্যন্ত তহবিলে জমা হয়েছে ১৮ লাখ ৫৬ হাজার ৫৭৩। গত নভেম্বরে বর্তমান অধ্যক্ষ দায়িত্ব নেওয়ার সময় তহবিলে ছিল ৩৯ লাখ ৪১ হাজার ৬০৭ টাকা। তহবিলে মোট ৫৭ লাখ ৯৮ হাজার ১৮০ টাকা থাকার কথা থাকলেও ১০ মাসে ৫৩টি চেকের মাধ্যমে ১৫ লাখ ১১ হাজার ৫৭৭ টাকা ব্যাংক থেকে তোলা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকে আছে ৪২ লাখ ৮৬ হাজার ৬০৩ টাকা।
অধ্যক্ষ খোন্দকার কামাল হাসান বলেন, বিবিধ তহবিলের টাকায় কলেজে কিছু উন্নয়নকাজ করা হয়েছে। এ তহবিলে ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা তোলার তথ্য সঠিক নয়।
সচেতন নাগরিক কমিটির বগুড়ার সভাপতি মাসুদার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আদর্শ মানুষ গড়ার বাতিঘর। কিন্তু সেখানেই যদি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ লুটপাট হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা কী নৈতিক শিক্ষা নেবেন।