শীতকালের সঙ্গে জড়িয়ে আছে খেজুরের রস। শীতের সকালে কাঁপতে কাঁপতে খেজুরের রস পানের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে যায় এই রস দিয়ে বানানো গুড়-পাটালির পিঠা-পায়েস। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা নওগাঁয় জেঁকে বসতে শুরু করেছে শীত। শীতের আগমনে খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছিদের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়েছে।
নওগাঁর রানীনগর থেকে আত্রাই পর্যন্ত রেললাইনের দুই পাশে এবং এর পাশ দিয়ে যাওয়া নওগাঁ-নাটের সড়কের দুই পাশে প্রায় ১৫ কিলোমিটারজুড়ে শত শত খেজুরগাছ। গতকাল শুক্রবার বিকেলে খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য নলি তৈরির কাজ করতে দেখা যায় কয়েকজন গাছিকে।
গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীতের শুরুতে কার্তিক মাসের মাঝামাঝি থেকে খেজুরগাছের রস সংগ্রহের জন্য কাটার কাজ শুরু হয়। এভাবে কয়েক দিন রেখে দেওয়া হয়। ১০ থেকে ১৫ দিন পর কাটা অংশে চোখ বা নলি তৈরি করা হয়। এই নলি দিয়ে রস ঝোলানো মাটির হাঁড়িতে গিয়ে পড়ে। যেদিন হাঁড়ি ঝোলানো হয়, পরের দিন সকালে গিয়ে রসসহ হাঁড়ি নামিয়ে আনেন গাছিরা।
গতকাল বিকেলে রানীনগর উপজেলার জিয়ানীবাজার এলাকার রেললাইনের পাশে খেজুরগাছে নলি তৈরির কাজ করছিলেন নাটোরের নলডাঙ্গা এলাকার গাছি সাইফুল ও জাকারিয়া। তাঁরা বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তাঁরা রানীনগর-আত্রাই রেলওয়ে লাইনের দুই পাশের ১৬০টি গাছ ২০ হাজার টাকায় এক বছরের জন্য ইজারা নিয়েছেন। এই গাছগুলো থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরির পর বিক্রি করেন তাঁরা। আবার এলাকার অনেক লোকজন গাছতলা থেকেই পানের জন্য রস কিনে নিয়ে যান।
গাছি সাইফুল বলেন, ‘১০ থেকে ১২ দিন হলো খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ শুরু করেছি। শুরুর দিকে হওয়ায় এখন রস পড়ছে কম। শীত একটু জেঁকে বসলে রস ভালো পড়বে। তখন রস মিষ্টিও হবে বেশি।’
নওগাঁর রানীনগর উপজেলার শাহগোলা গ্রামের গাছি সন্তোষ কুমার (৫৫) এবার ২০টি খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করবেন। তিনি বলেন, ‘প্রায় ৩০ বছর ধরে শীতকাল এলেই খেজুরগাছ থেকে রস নেওয়ার কাজ করি। এবার ২০টা গাছত ঠুঙ্গি লাগাইছি। এর মধ্যে পাঁচটা গাছ নিজের। আর বাকি ১৫টা গাছ অন্য একজনের কাছ থেকে লিজ নিছি। যার কাছ থেকে লিজ নিছি, তাক এই সিজনত ১০ কেজি গুড় আর খাওয়ার জন্য একটু রস দিলেই হবে।’ তিনি বলেন, খেজুর রস সংগ্রহ করে খুব একটা লাভ যে হয়, তা না; তবে মৌসুমি আয়ের পথ বলে এটা করেন।
আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ গ্রামের গাছি ছাবের দেওয়ান এবার নিজের ১৭টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করবেন। তিনি বলেন, আগের মতো তাঁদের এলাকায় খেজুরগাছ পাওয়া যায় না। অনেক মালিক গাছ কেটে ফেলেছেন। তবে সেই পরিমাণ নতুন করে গাছ লাগানো হয়নি। শীতের সময় রস পাওয়া ছাড়া গাছগুলো থেকে তেমন কিছু হয় না। এ কারণে অনেকে খেজুরগাছ রাখেন না। আবার অনেকে গাছ কেটে মাটির বাড়ি নির্মাণে ব্যবহার করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় প্রায় ১৫০ হেক্টর জমিজুড়ে খেজুরগাছ আছে। চলতি বছর এসব গাছ থেকে গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছ ৮৫০ মেট্রিক টন।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপপরিচালক আবু কালাম আজাদ বলেন, খেজুরগাছের উপরিভাগের নরম অংশে চাঁছ দিয়ে রস নামানো হয়। একবার গাছে চাঁছ দিলে দুই থেকে তিনবার রস পাওয়া যায়। সাধারণত খেজুরগাছ পূর্ব ও পশ্চিম দিকে কাটা হয়, যাতে সূর্যের আলো সরাসরি ওই কাটা অংশে পড়তে পারে। সূর্যের আলো পড়লে রস বেশি মিষ্টি হয়। তিনি রস সংগ্রহের জায়গা নেট দিয়ে ঢেকে দিতে চাষিদের পরামর্শ দেন যেন রসে পাখি বা বাদুড় মুখ দিতে না পারে। এতে নিপাহ ভাইরাস হওয়ার আশঙ্কা কমে।