পাঠ্যবইয়ে নেই, নিজেদের গানে বেঁচে আছেন সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক সিধু-কানু

শিল্পীর তুলিতে সাঁওতাল বিদ্রোহ
ছবি: সংগৃহীত

আজ ৩০ জুন ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। সাঁওতাল বিদ্রোহীদের সেদিনের আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জুগিয়েছিল সাহস ও উদ্দীপনা। মুক্তিকামী মানুষের কাছে আজও তা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।

সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়ক দুই ভাই সিধু মুরমু ও কানু মুরমু স্মরণে সাঁওতালদের অনেকেই দিনটিকে ‘সিধু-কানু দিবস’ বলে থাকেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ত জমিদার, সুদখোর, তাদের লাঠিয়াল বাহিনী, দারোগা-পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সাঁওতাল নেতা সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব—এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে রুখে দাঁড়ান সাঁওতালরা। সঙ্গে ছিলেন তাঁদের দুই বোন ফুলোমণি মুরমু ও ঝালোমণি মুরমু।

এবার বিদ্রোহের ১৬৮তম বার্ষিকীতে জাতীয় আদিবাসী পরিষদসহ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের বিভিন্ন সংগঠন ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে দিবসটি উদ্‌যাপন করবে।

আজ বরেন্দ্র অঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার নিভৃত সাঁওতাল পল্লি মিরাকাঠাল ও আশপাশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার গ্রামের মানুষেরা মিরাকাঠাল গ্রামে সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস উদ্‌যাপন করবেন। উদ্যোক্তাদের অন্যতম এলাকার সাঁওতাল নেতা বিরেন বেসরা প্রথম আলোকে বলেন, শোভাযাত্রা, সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা সিধু ও কানু প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদ্‌যাপন করা হবে।

সাধারণ নিরক্ষর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস না জানলেও বংশপরম্পরায় তাঁদের কাছে গানে গানে বেঁচে আছেন সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়কেরা। সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসে তাঁদের আজও গাইতে শোনা যায়, “সিদো-কানহু খুড়খুড়ি ভেতরে চাঁদ-ভায়রো ঘোড়া ওপরে দেখ সে রে! চাঁদরে! ভায়রো রে! ঘোড়া ভায়য়োরে মুলিনে মুলিনে।”’

বিরেন বেসরা বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তকের ইতিহাস বইয়ে সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা জানতে পারে না আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু আমাদের অনেক বয়স্ক নারী ও পুরুষ সিধু-কানু ও বিদ্রোহে নায়কদের নিয়ে গান জানেন। সাধারণ নিরক্ষর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃত ইতিহাস না জানলেও বংশপরম্পরায় তাঁদের কাছে গানে গানে বেঁচে আছেন সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়কেরা। সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসে তাঁদের আজও গাইতে শোনা যায়, “সিদো-কানহু খুড়খুড়ি ভেতরে চাঁদ-ভায়রো ঘোড়া ওপরে দেখ সে রে! চাঁদরে! ভায়রো রে! ঘোড়া ভায়য়োরে মুলিনে মুলিনে।”’

সিধু-কানু পালকিতে এবং চাঁদ-ভৈরব ঘোড়ায় চড়ে বিদ্রোহীদের পাশে থেকে তাঁদের উৎসাহ দিতেন। নেতাদের কাছে পেয়ে বিদ্রোহীদের মনে যে আনন্দ ও আশার আলো দেখা দিত, তারই প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় এই গানে।

শিল্পীর তুলিতে সাঁওতাল বিদ্রোহ

এদিকে নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আগরাদ্বিগুণ গ্রামে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) উপজেলা শাখা নানা আয়োজনে দিবসটি উদ্‌যাপন করবে। বাসদ নওগাঁ জেলার আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে জানান, এলাকার সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন।

এ ছাড়া প্রতিবছরের মতো এই দিনে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা ও বিস্তীর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতাল জনগোষ্ঠী, বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ এবং দেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠন সিধু-কানুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পাঞ্জলি, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আয়োজন করেছে।

কী ঘটেছিল ৩০ জুন

ভারতের ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইল এলাকা দামিন-ই-কোহ্ বা ‘পাহাড়ের ওড়না’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। ভাগলপুরের ভগনা ডিহি গ্রামের সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব—এই চার ভাইয়ের নেতৃত্বে দামিন-ই-কোহ্ অঞ্চলে সংঘটিত হয় সাঁওতাল বিদ্রোহ। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ভগনা ডিহি গ্রামে ৪০০ গ্রামের প্রতিনিধি ১০ হাজার সাঁওতাল কৃষকের বিরাট জমায়েত হয়। এই জমায়েতে সিধু-কানু ভাষণ দেন। এ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, অত্যাচারী শোষকদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবাইকে এক হয়ে লড়তে হবে। এখন থেকে কেউ জমির কোনো খাজনা দেবেন না এবং প্রত্যেকেরই যত খুশি জমি চাষ করার স্বাধীনতা থাকবে। আর সাঁওতালদের সব ঋণ এখনই বাতিল হবে। তাঁরা মুলুক দখল করে নিজেদের সরকার কায়েম করবেন।

১০ হাজার সাঁওতাল কৃষক সেদিন শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়েছিলেন। ভগনা ডিহি গ্রামের ওই সভার শপথ ছিল বিদ্রোহের শপথ। বিদ্রোহের মূল দাবি ছিল ‘জমি চাই, মুক্তি চাই’। জমিদার, মহাজন ও ব্রিটিশ সরকারের শোষণ ও জুলুম থেকে মুক্ত হয়ে শান্তির সঙ্গে উৎপাদনের কাজ ও জীবন ধারণ করার সংকল্প নিয়ে সাঁওতাল কৃষকেরা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ান। তাঁদের এ বিদ্রোহের সঙ্গে যোগ দেন এলাকার শোষিত, বঞ্চিত বাঙালি ও বিহারি হিন্দু-মুসলমান গরিব কৃষক এবং কারিগরেরা। সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়ে উঠেছিল সব সম্প্রদায়ের গরিব জনসাধারণের মুক্তিযুদ্ধ।