থানা ও বাসভবনে লাগানো যে দুটি এসি ওসি খুলে নিয়ে গেছেন, তা টিআরের টাকায় কিনে দিয়েছিলেন সংসদ সদস্য।
হবিগঞ্জের বাহুবল থানার বদলি হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুল ইসলাম খান যে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) খুলে নিয়ে গেছেন, তা লাগানো হয়েছিল গরিব মানুষের জন্য সরকারের দেওয়া টেস্ট রিলিফ বা টিআরের টাকায়।
স্থানীয় সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহ নওয়াজ টিআরের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে থানায় ওসির কক্ষে ও তাঁর সরকারি বাসভবনে ওই এসি লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
বাহুবল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিবুল ইসলাম খানকে গত মাসে একই জেলার মাধবপুর থানায় বদলি করা হয়। তিনি বদলির আদেশ পাওয়ার পর গত ১০ আগস্ট থানা ও সরকারি বাসভবনে স্থাপিত দুটি এসি খুলে নিয়ে যান। তিনি এসির সঙ্গে থানায় সমাজসেবকদের দান করা আসবাব ও সৌন্দর্যবর্ধনের সামগ্রীও নিয়ে যান।
বিষয়টি নিয়ে ১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় ‘সরকারি অর্থে কেনা থানার দুটি এসি খুলে নিলেন বদলি হওয়া ওসি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে অনুসন্ধান করে জানা যায়, এসি দুটি কেনা হয়েছিল টিআরের টাকায়।
বদলি হওয়া ওসি রকিবুল ইসলাম খানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। পরে গত শনিবার বিকেলে মাধবপুর থানায় গিয়ে কয়েক ঘণ্টা বসে থেকে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
বাহুবল মডেল থানায় গত বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা যায়, ওসির কক্ষে ও তাঁর সরকারি বাসভবনে এসি নেই। থানাটির নতুন ওসি মো. মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এসি আগে ছিল কি না, সে বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
বাহুবল থানায় ২০২১ সালের অক্টোবরে ওসি হিসেবে যোগদান করেন রকিবুল ইসলাম খান। তিনি যোগদানের পর হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহ নওয়াজ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের টিআর কর্মসূচির অধীনে ‘বাহুবল মডেল থানায় এসি স্থাপন’ প্রকল্পের আওতায় ২০২১ সালের ১৯ জুলাই ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন।
বরাদ্দের বিপরীতে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি এসি কেনার জন্য গঠিত ক্রয় কমিটির চেয়ারম্যান জনৈক সামায়ুন চৌধুরীর অনুকূলে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার একটি চেক হস্তান্তর করেন। এ অর্থ দিয়েই দুটি এসি লাগানো হয়।
এ ঘটনায় পরিষ্কার যে রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহার করে একজন সংসদ সদস্য একজন ওসিকে তুষ্ট করতে চেয়েছেন। ওসি এসি গ্রহণ করেছেন বিধিসম্মত প্রক্রিয়ার বাইরে। এখানে দুই পক্ষই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে।ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি
সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহ নওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিআর বরাদ্দ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করা যায়। থানা জনগণের প্রতিষ্ঠান। এ হিসেবে আমি এ বরাদ্দ দিয়েছিলাম। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার এ বরাদ্দের আইনি অধিকার আছে।’
এসি খুলে নেওয়ার বিষয়ে সংসদ সদস্য বলেন, ‘আমি হবিগঞ্জের পুলিশ সুপারকে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানিয়েছি। তিনি কী ব্যবস্থা নেন, সেই অপেক্ষায় আছি।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে টিআর (গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ) কর্মসূচি বাস্তবায়নের নির্দেশিকা রয়েছে। এতে এই কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অংশে বলা হয়েছে, এই কর্মসূচি নেওয়া যাবে মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য। মন্ত্রণালয়ের সাবেক একজন সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, টিআরের টাকা ব্যয় হবে গরিবের কল্যাণে। ওসির জন্য এসি কেনা গরিবের কল্যাণ নয়।
গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ–সংক্রান্ত উপজেলা কমিটির সভাপতি পদে থাকেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। বাহুবল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ওসি যে কাজটি করেছেন, তা সম্পূর্ণ অন্যায়। আরও বড় অন্যায় করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহ নওয়াজ।
টিআরের টাকা কোথায় ব্যবহার করা যায় এবং এসি কেনার জন্য ব্যয় করা যায় কি না, তা জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল বাহুবল উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. তাজ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহৃত হবে টিআরের অর্থ। ওসির অফিস ও তাঁর সরকারি বাসভবনের জন্য টিআর থেকে বরাদ্দের বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে অসম্মতি জানান।
এদিকে মাধবপুর থানায় বদলি হয়ে সেখানে যোগ দিয়েছেন রকিবুল ইসলাম খান। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
কোনো থানার ওসির অফিসে বা তাঁর বাসায় এ ধরনের এসি লাগানোর বিষয়টি সরকারি নিয়মে নেই এবং এর জন্য কোনো বরাদ্দও নেই বলে জানান হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম মুরাদ আলি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যদি কেউ এসি দিয়ে থাকেন, তিনিই ভালো জানেন কেন দিয়েছেন? আবার যিনি গ্রহণ করেছেন, তাঁরও পুরো বিষয়টি জানা, কেন গ্রহণ করেছেন।
এস এম মুরাদ আলি আরও বলেন, ‘যখন সংবাদপত্রে এ নিয়ে লেখালেখি হয়, তখন বিষয়টি আমার নজরে আসে।’ এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ না পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সংসদ সদস্য যদি এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ করেন, তাহলে অবশ্যই বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কোনো সরকারি কর্মচারী উপহার নিতে পারেন কি না, তা উল্লেখ রয়েছে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় (১৯৭৯)। এতে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো উপহার নিজে বা পরিবারের কোনো সদস্য নিতে পারবেন না, যা তাঁকে কোনো উপায়ে তাঁর অফিসের কার্য সম্পাদনে উপহারদাতার প্রতি প্রতিদানের বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ করে।
গরিবের টাকায় এসি দেওয়া নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় পরিষ্কার যে রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহার করে একজন সংসদ সদস্য একজন ওসিকে তুষ্ট করতে চেয়েছেন। ওসি এসি গ্রহণ করেছেন বিধিসম্মত প্রক্রিয়ার বাইরে। এখানে দুই পক্ষই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। বিষয়টিতে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে এসপির অভিযোগের অপেক্ষায় থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা কোনো কথা হতে পারে না। এটা বাংলাদেশ পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক বিধিমালার লঙ্ঘন।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, পুলিশের শুধু এসপি কেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে। দুই পক্ষকেই জবাবদিহির ভেতরে আনতে হবে।