১৯৭১ সালের জুলাই মাসে দর্শনা কলেজের তিন শিক্ষককে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। এরপর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি তাঁদের।
শিক্ষাবিদ লতাফত হোসেন জোয়ার্দার ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। অল্পদিনেই শিক্ষার্থী-অভিভাবক, সহকর্মী ও দর্শনবাসীর প্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কলেজের ছাত্র ও স্থানীয় তরুণ-যুবকদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন তাঁর নেতৃত্বে একদল শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে যাওয়া ছেলেদের খাবার ও টাকাপয়সা দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ান তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এই অধ্যক্ষ ও অনুসারী শিক্ষকদের তৎপরতার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত গোপন থাকেনি। ৩১ জুলাই পাকিস্তানি সেনারা অধ্যক্ষ ও তাঁর দুই সহকর্মী বাংলা বিভাগের রফিকুল ইসলাম ও পৌরনীতির নাসির উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যায়। সেই থেকে আর সন্ধান পাওয়া যায়নি তাঁদের।
শহীদ তিন শিক্ষকের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কলেজ চত্বরে ১৯৮২ সালে মুক্তমঞ্চ তৈরি করা হয়। ২০০৪ সালে সেখানে স্থাপিত হয় স্মৃতিফলক। কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করেন। থাকে আলোচনা সভার আয়োজনও। যেখানে শহীদ শিক্ষকদের পরিবারের সদস্য এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
দুই মাস আগে দর্শনা কলেজের পদে যোগ দিয়েছেন শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী তিন সহকর্মীর গৌরবগাথা সহকর্মীদের কাছে শুনেছি। তাঁরা সবাই আদর্শবান শিক্ষক ছিলেন। আমরা তাঁদের আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করি, যা আমাদের চলার পথের পাথেয়। তাঁদের আত্মত্যাগে গর্বিত দর্শনা সরকারি কলেজ। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে তিন শিক্ষকের স্মরণসভা ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) দর্শনা শাখার বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সংস্কৃতিকর্মী এ কে এম রবিউল আলম ১৯৭১ সালে ছিলেন দর্শনা কলেজে একাদশ শ্রেণির ছাত্র ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘অধ্যক্ষ লতাফত হোসেন ছিলেন প্রগতিশীল মানুষ। রফিকুল স্যার বাম রাজনীতি ও নাসির উদ্দিন সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁরা সাংগঠনিকভাবে তৎপর ছিলেন এবং থিঙ্ক ট্যাংক হিসেবে কাজ করতেন। যে কারণে তাঁরা পাকিস্তানি বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন।’
সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্ত্রীকে দর্শনা থেকে বরিশালে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রফিকুল ইসলাম। দর্শনায় নিজ বাসায় না থেকে তাঁর ভাই কেরু কোম্পানির কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের বাসায় থাকতেন। ওই বাসায় দর্শনা কলেজের অধ্যক্ষ লতাফত হোসেন জোয়ার্দার ও অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ফজলুর রহমানও আশ্রয় নিয়েছিলেন। মতান্তরে ৩১ জুলাই দর্শনায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা রফিকুল ইসলামসহ তিন শিক্ষককে ও বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।
রফিকুল ইসলামের স্ত্রী হোসনে আরা বেগম জানান, ঘটনার দিন এক বছর তিন মাস বয়সী মেয়ে তাহসিনা ইসলামকে নিয়ে তিনি বরিশাল শহরের বাড়িতে ছিলেন। তখন ছেলে তানভীর তাঁর গর্ভে। পাকিস্তানি সেনারা রফিকুলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দুই দিন পর বিষয়টি তিনি জানতে পারেন। ছেলেকে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। তিনি বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার স্বামী আত্মদান করায় আমি ও আমার দুই সন্তান গর্বিত।’