‘গ্যাসের আগুনে আমার আব্বা মারা গেল। এরপর আমার ছোট ভাইটাও মারা গেল। খুবই কষ্টে আছি ভাই। হাসপাতালে মা এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। ডাক্তার বলছেন, তার অবস্থাও বেশি ভালো না। আব্বা যে মারা গেছে, সেটি মিনার (মিনারুল ইসলাম) জানত না। আব্বা ও মিনারের মৃত্যু খবরও এখনো মাকে জানানো হয়নি।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার বাকতোয়া লক্ষ্মীপুরা গ্রামের দুলু মিয়া। ১৩ আগস্ট (রোববার) রাতে গাজীপুর মহানগরীর বোর্ডবাজার (মুক্তারবাড়ি) এলাকায় বাসায় জমে থাকা গ্যাসের বিস্ফোরণে দগ্ধ হন তাঁর বাবা ফরমান মণ্ডল, মা খাদিজা বেগম ও ছোট ভাই মিনারুল ইসলাম। তাঁদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সোমবার বিকেলে মারা যান ৯৫ শতাংশ দগ্ধ ফরমান মণ্ডল। বৃহস্পতিবার সকালে মারা যান মো. মিনারুল ইসলাম।
খাদিজা বেগম এখনো হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মিনারুল গাজীপুরে অবস্থিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি স্ত্রী ও শিশুসন্তানকে নিয়ে বোর্ডবাজার এলাকার ওই বাসায় ভাড়া থাকতেন।
আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় মিনারুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তাঁদের গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার বাকতোয়া লক্ষ্মীপুরা গ্রামে। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
মুঠোফোনে মিনারুলের বড় ভাই দুলু মিয়া বলেন, ‘গ্যাসের আগুনে আমার ভাই ও আমাদের পরিবারটাক শেষ হয়ে গেল। কয়েক দিন আগেও ছোট ভাই ও মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে।’
মিনারুলের মৃত্যুতে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতকোত্তর পাস করা স্ত্রী সুরাইয়া খাতুন। শুক্রবার সকালে তাঁর মুঠোফোনে কল করা হলে ফোন ধরেন বান্ধবী ফাহমিদা পারভীন। তিনি বলেন, সুরাইয়া মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। কথা বলার অবস্থায় নেই।
স্বামীর মৃত্যুর পর গতকাল দুপুরে সুরাইয়া খাতুন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমার মাত্র পড়া শেষ হলো। মেয়ে মুনতাহারের বয়স মাত্র ৯ মাস ১৮ দিন। কী থেকে কী হইল, আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না।’
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক হোসাইন ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার দুপুরে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছিল মিনারুল ইসলামকে। তাঁর মানসিক জোর ছিল অনেক। সেদিন রাতেই তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। বুধবার বিকেল থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় মারা যান তিনি।
বর্তমানে মিনারুলের মা খাদিজা বেগমের চিকিৎসা চলছে জানিয়ে হোসাইন ইমাম বলেন, তাঁর শরীরের ৪০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তবে তাঁর শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। আগে থেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। সে কারণে তাঁর শারীরিক অবস্থাও শঙ্কামুক্ত নয়।
পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে মিনারুল ইসলাম ছিলেন চতুর্থ। তিনি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে চার বছর আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণ দপ্তরের সেকশন অফিসার হিসেবে যোগ দেন।
মিনারুল ইসলাম ও তাঁর পিতা ফরমান আলী মণ্ডলের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. মশিউর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক আতাউর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার বাদ আসর রাজধানীর ধানমন্ডিতে ঈদগাহ মসজিদে মিনারুলের প্রথম জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. মশিউর রহমান। এ সময়ে তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
জানাজায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউটের ডিস্টিংগুইশ প্রফেসর মাহবুবর রহমান, বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।