নান্দনিক, আরামদায়ক ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বিশ্বের বহু দেশে কাঠের তৈরি বাড়ির চাহিদা বেড়েছে। বিশেষ করে পার্ক, রিসোর্ট, কটেজে এমন স্থাপনার কদর ব্যাপক। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবার ইউরোপে সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি বাড়ি রপ্তানি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান। বাড়ির কাঠামো, দেয়াল এমনকি ছাদও কাঠের তৈরি। পর্যটকদের থাকার জন্য ‘বোট টাইনি হাউস’ নামের ইকো-কটেজগুলো দেখতে অনেকটা উল্টো নৌকার মতো। ঘরের পাশাপাশি চেয়ার-টেবিল, আলমারি, খাটসহ সব আসবাব কাঠের তৈরি।
এসব বাড়ি তৈরি হচ্ছে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের প্রত্যন্ত গ্রাম কররীতে। সেখানকার ‘ন্যাচারাল ফাইবার’ নামের কারখানাটি বেলজিয়ামের জনপ্রিয় বোটানিক্যাল গার্ডেন ও চিড়িয়াখানা ‘পাইরি ডাইজা’র জন্য এসব ঘর তৈরি করছে। আসবাবসহ প্রাথমিকভাবে ১১০টি ঘরের ক্রয়াদেশ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
২৭ এপ্রিল দুপুরে কররী গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, স্থানীয় শ্রমিকেরা কারখানার মূল শেডে দেশি প্রযুক্তিতে ঘর তৈরি করছেন। প্রথমে কাঠের ফ্রেমে মূল কাঠামো দাঁড় করানোর পর ওপরে ছোট ছোট তক্তা লাগাচ্ছেন। পাশে তক্তাগুলো প্রস্তুত করছেন অন্য শ্রমিকেরা। পুরো কাজ তদারক করছেন কয়েকজন বিদেশি। তাঁরা হাতে-কলমে খুঁটিনাটি পরামর্শ দিচ্ছেন।
বিদেশি পরামর্শকদের সঙ্গে শ্রমিকদের যোগাযোগ থেকে শুরু করে সার্বিক দেখভাল করছিলেন ন্যাচারাল ফাইবার কারখানার প্রধান নির্বাহী মোজাহিদ আহমেদ। তিনি বলেন, বেলজিয়ামের ‘পাইরি ডাইজা’ ইকো-পার্ক অবকাঠামোর বড় পরিবর্তন আনছে। যার সবকিছুই কাঠের হবে। ‘বোট টিনি হাউস’ নামের এই ঘর বানানোর জন্য ব্রিটেন, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দরপত্রে অংশ নিয়ে তাঁরা কাজ পেয়েছেন। এ জন্য প্রথম নমুনা ঘরটি তাঁরা তৈরি করছেন।
এর আগে বেলজিয়ামের ওই পার্কে হাতি চলাচলের করিডর ও বেড়া দেওয়ার চার শতাধিক খুঁটি তৈরির কাজ পেয়েছিল ন্যাচারাল ফাইবার। প্রথম চালানে ১৬২টি ইতিমধ্যে বেলজিয়ামে পাঠানো হয়েছে।
মোজাহিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, খুঁটির কাজটিতে তাঁরা বেশ সন্তুষ্ট হয়েছেন। এ জন্য ঘর তৈরির বড় কাজটিতে তাঁরা ন্যাচারাল ফাইবারের ওপর আস্থা রেখেছে। তিনি বলেন, ঘরের ছাদ যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য আইপিই বা ইপে নামের একধরনের বিশেষ কাঠ ব্যবহার করা হবে। ওপরে পানি প্রতিরোধী প্রলেপ দেওয়া থাকবে। কোনো রং করা হবে না। ইপে আফ্রিকান গাছ, বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে। এ ছাড়া সবই স্থানীয় গাছ দিয়ে তৈরি হবে।
ঘরের একেকটি অংশ আলাদাভাবে ভাগ করে বেলজিয়ামে পাঠানো হবে। প্রতিটি ঘর লম্বায় ১১ মিটার এবং প্রস্থ ৩ দশমিক ৭৫ মিটার। ন্যাচারাল ফাইবারকে ঘর তৈরির কাজে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে গ্রিসের ‘কোকো-ম্যাট’ ও বেলজিয়ামের ‘নোই বিল্ডার্স’। এর মধ্যে ‘কোকো-ম্যাট’ ন্যাচারাল ফাইবারের পুরোনা ক্রেতা। তাদের তৈরি নারকেলের ছোবড়ার ডিসপোজিবল হোটেল স্লিপার, কাঠের বেবি ব্যালান্স সাইকেল, সান বেড, পোষা প্রাণীর বিছানা, খেলনাসহ নানা পণ্যের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি।
কররী গ্রামের কারখানায় বসে ‘কোকো-ম্যাট’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা পল এফমরফিডিসের সঙ্গে কথা হয়। বাংলাদেশে এসে তিনি খুবই গর্বিত। পল প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপের অন্যতম বড় চিড়িয়াখানা পাইরি ডাইজার জন্য তাঁরা কাঠ দিয়ে বাড়ি তৈরি করছেন। বাংলাদেশের মেহগনিগাছের কাঠ এতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ঘরের ভেতরের সবকিছু হবে কাঠের। সবটা এখানেই তৈরি হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বকে দেখাতে চাই জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ভিন্নভাবে কাজ করা যায়।’
নোই বিল্ডার্সের প্রতিষ্ঠাতা এভাঞ্জেলিয়া পালিয়ারি বলেন, বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা মোজাহিদ একসময় কাজের জন্য গ্রিসে ছিলেন। বাংলাদেশি উদ্যোক্তা জানার পর তাঁদের সহায়তা করতে চেয়েছেন। এখন তাঁদের বাড়িতে থাকছেন। তাঁদের পরিবার এখানকার (বাগেরহাট) গ্রামীণ নারীদের কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। এটি একটি সামাজিক প্রকল্প। তাঁরা তাঁদের এগিয়ে নিতে চান।
বাগেরহাটের স্থানীয় কাঠমিস্ত্রিদের সুযোগ দিতে চান এভাঞ্জেলিয়া। বললেন, ‘যাঁরা এখানে আমাদের সঙ্গে কাজ করবেন, তাঁদের মধ্য থেকে আমরা কয়েকজনকে ইউরোপে নিয়ে যাব। সেখানে তাঁরা ঘরগুলো স্থাপনের কাজ করবেন। আশা করছি, এটি যাত্রার শুরু। সামনে আরও অনেক কাজের সুযোগ তৈরি হবে।’
ন্যাচারাল ফাইবারের চেয়ারম্যান মোস্তাফিজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নতুন নতুন পণ্য নিয়ে কাজের ধারাবাহিকতায় তাঁরা গত বছর কাঠের সাইকেলসহ পরিবেশবান্ধব বেশ কিছু পণ্যের ক্রয়াদেশ পেয়েছিলেন। তাদের মাধ্যমে এবার বেলজিয়ামের একটি ইকোপার্কের জন্য ফেন্সিং পিলারের ফরমাশ পান। এরপর ঘরের কাজটি পেয়েছেন। পার্ক কর্তৃপক্ষ ঘরের নকশা দিলে তাঁরা তৈরি করে দেখান। তাঁরা সেটি পছন্দ করেছেন। কোথায় কোন কাঠের ব্যবহার হবে, কীভাবে ট্রিটমেন্ট করতে হবে সবকিছু চূড়ান্ত। ঘরের গুণগত মানের জন্য তাঁদের কনসালট্যান্ট এক মাস থরে তাঁদের সঙ্গে কাজ করছেন। আগামী জুনের মধ্যে ঘরগুলো রপ্তানি শুরু হবে।
ইউরোপের অন্য দেশেও এমন পাঠানোর আলাপ চলছে জানিয়ে মোস্তাফিজ আহমেদ বলেন, ঘরের একেকটি অংশ আলাদা করে কনটেইনারে মাধ্যমে বেলজিয়াম পাঠানো হবে। তাঁদের কর্মীরা সেখানে গিয়ে ঘর অ্যাসেম্বল (সাজিয়ে) করে দিয়ে আসবেন। বর্তমানে ঘর তৈরির জন্য ৯০ জন দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক কাজ করছেন। আরও শতাধিক শ্রমিক তাঁদের দরকার।