‘টাকডুম টাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’...’, ‘তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসোনি...’, ‘শোনো গো দখিনও হাওয়া প্রেম করেছি আমি...’, ‘তোরা কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া...’—এ রকম অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছিলেন শচীন দেববর্মন। শচীনকর্তার কণ্ঠের সুর আজও ছড়িয়ে আছে কোটি বাঙালির হৃদয়ে। বাংলার পাশাপাশি হিন্দি গানেও শচীন দেববর্মন এক অবিস্মরণীয় নাম।
কালজয়ী এই সংগীতজ্ঞ ১৯০৫ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লা নগরের দক্ষিণ চর্থায় জন্মগ্রহণ করেন। কুমিল্লার রত্ন হলেও শুধু জন্ম আর মৃত্যুদিন ছাড়া সারা বছরই জন্মস্থান কুমিল্লায় অবহেলায় থাকেন শচীন। দীর্ঘদিন ধরে এই সুরসম্রাটের কুমিল্লা নগরের চর্থার বাড়িটিতে শচীন কমপ্লেক্স বা সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স করার দাবি জানানো হলেও সেটি আজও করা হয়নি। শচীন দেববর্মন ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবরে ভারতে মারা যান।
একই মাসে জন্ম ও মৃত্যু হওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এই সুরসম্রাটের বাড়িটিতে আয়োজন করা হয় শচীন মেলার। এবারও তাঁর প্রয়াণদিবসে দুই দিনব্যাপী মেলা বসেছে শচীনকর্তার বাড়িতে। আজ বুধবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বেলুন উড়িয়ে এই মেলার উদ্বোধন করেছেন জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার। আগামীকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে এই মেলা। শচীন মেলা উপলক্ষে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে।
কুমিল্লার ইতিহাস–গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, ‘আমাদের অহংকারের ধন, সুরের রাজকুমার শচীন দেববর্মনকে আমরা আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। শচীনকর্তার জন্ম ও মৃত্যুতারিখ এলেই আমাদের ঘুম ভাঙে। তাঁর স্মৃতি ও সংগীতকে ধরে রাখার জন্য এবং তাঁর কর্মকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় কিংবা সাংগঠনিক তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। কুমিল্লার নাগরিক সমাজের পক্ষে শচীনকর্তার বাড়িটিতে পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলার জন্য দাবি জানাই।’
আহসানুল কবীর আরও বলেন, ‘শচীনকর্তার বাড়িতে গানের জলসায় অনেক খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ আসতেন। কবি নজরুলও অনেকবার গানের জলসায় অংশ নেন। জাতীয় কবির বেশ কয়েকটি গানেও সুর দিয়েছেন শচীনকর্তা। বিশেষ করে কবি নজরুলের দুটি বিখ্যাত গান “চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে...”, “পদ্মার ঢেউ রে, মোর শূন্য হৃদয়...” এই দুটি গানে সুরকার শচীনকর্তা। কিন্তু কুমিল্লা তথা উপমহাদেশের সংগীতরত্ন শচীন দেববর্মন জন্মস্থানে সারা বছর অবহেলিত থাকেন—এটি খুবই বেদনাদায়ক।’
স্থানীয় লোকজন জানান, মেলা উপলক্ষে শচীন দেববর্মনের বাড়িটি এখন সাজানো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। কিন্তু বছরের বেশির ভাগ সময় বাড়িটি মাদকসেবীদের দখলে থাকে। জেলা প্রশাসনের নিযুক্ত একজন পাহারাদার বাড়িটি পাহারা দেওয়ার কথা থাকলেও প্রায়ই বাড়িটি থাকে অরক্ষিত। বাড়িটিতে শচীন কমপ্লেক্স নির্মাণ করে সুরসম্রাটের কীর্তি মানুষকে জানানোর দাবি এখন সবার।
কুমিল্লা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একাধিক ব্যক্তি জানান, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর শচীন দেবের বাড়িটি পরিত্যক্ত ছিল। ওই সময়ের পর বাড়িটি দখল করে সরকারি মুরগির খামার গড়ে তোলা হয়। কুমিল্লার সাংস্কৃতিক সংগঠকদের দাবি ও আন্দোলনের মুখে ২০১৪ সালে বাড়িটির একাংশ উদ্ধার করা হয়। এরপর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সোয়া কোটি টাকায় বাড়িটি সংস্কার করা হয়। ২০১৮ সালে সংস্কারকাজ শেষ হওয়ার পর অযত্নে ফেলে রাখায় বাড়িটি ফের বেহাল হয়ে পড়ে। চুরি হয়ে গেছে বাড়ির অনেক মালামাল।
সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঐতিহ্য কুমিল্লা’র পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ইমরুল বলেন, সংস্কারের পর থেকেই সংগীতজ্ঞ শচীন দেববর্মনের বাড়িটিতে শচীন কমপ্লেক্স করার কথা ছিল। তবে এখনো সেটি হয়নি, যার কারণে বাড়িটি পুনরায় পরিত্যক্ত বাড়িতে পরিণত হচ্ছে। দ্রুত শচীনকর্তার বাড়িটিতে পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স দেখতে চায় কুমিল্লার মানুষ।
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, ‘উপমহাদেশের কালজয়ী সংগীতজ্ঞ শচীন দেববর্মনের স্মরণে আমরা প্রতিবছর শচীন মেলার আয়োজন করছি। তাঁর বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসনের একজন পাহারাদার নিয়োজিত আছেন। এ ছাড়া সারা বছরই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শচীন দেবকে নিয়ে কুমিল্লার স্থানীয় শিল্পীদের বিভিন্ন পরিবেশনা থাকে। আর আমরা এরই মধ্যে তাঁর বাড়িতে পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স করার জন্য মাস্টারপ্ল্যান করেছি। শিগগিরই পুরো প্ল্যানটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’
শচীন দেববর্মনের বাবা ছিলেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার রাজপরিবারের সন্তান সংগীতশিল্পী নবদ্বীপ চন্দ্র দেব। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি সপরিবার কুমিল্লা চলে আসেন। চর্থায় তাঁদের বাড়ির জমি দিয়েছিলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত নবাব ফয়জুন্নেসা। শচীন দেববর্মনের সংগীতপ্রতিভার বিকাশ ঘটে শিশুকাল থেকেই। শচীন দেববর্মন কুমিল্লায় ছিলেন ১৯২৪ সাল পর্যন্ত। ১৯ বছর বয়সে তিনি চলে যান কলকাতায়, সেখানে থাকতেন ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৪ সালে তিনি সপরিবার মুম্বাই চলে যান। মুম্বাই চলচ্চিত্রজগতে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের মর্যাদা লাভ করেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত করে। ১৯৬৯ সালে ‘আরাধনা’ হিন্দি ছবিতে শ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক হিসেবে তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তাঁর স্ত্রী মীরা দেবীও এ উপমহাদেশের অন্যতম সুগায়িকা এবং দক্ষ গীতিকার ছিলেন। স্ত্রীর রচিত বহু গান শচীন দেববর্মন গেয়েছেন। শচীন দেব বর্মন ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর মারা যান। তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠান মুম্বাইয়ে সম্পন্ন হয়। শচীন দেববর্মনের একমাত্র ছেলে রাহুল দেববর্মন, যিনি আর ডি বর্মন হিসেবে বেশি পরিচিত। পুত্রবধূ উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী আশা ভোসলে। শচীন দেববর্মনের অসংখ্য অনুরাগীর মধ্যে কিংবদন্তি ক্রিকেট শচীন টেন্ডুলকারের বাবা রমেশ টেন্ডুলকার একজন। তাঁর নাম থেকেই তিনি ছেলের নাম রাখেন শচীন।