ধার-দেনা করে দুটি পুকুরে মাছচাষের জন্য প্রায় ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার বাদে আমতৈল গ্রামের চাষি সাইফুল ইসলাম। একই উপজেলার চানদুয়াইল গ্রামের যশু মিয়া তিনটি পুকুরে বিনিয়োগ করেন প্রায় ১৬ লাখ টাকা। এগুলো নিয়ে তাঁদের অনেক স্বপ্ন আর প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বন্যার পানিতে পুকুরগুলোর প্রায় সব মাছ ভেসে গেছে।
শুধু সাইফুল বা যশু নন, তাঁদের মতো অন্য উপজেলা দুর্গাপুর, পূর্বধলা, বারহাট্টা ও সদরের প্রায় দেড় হাজার মাছচাষির স্বপ্ন এবার ভেসে গেছে বন্যার পানিতে। জেলার মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাব বলছে, সর্বশেষ বন্যায় নেত্রকোনার পাঁচ উপজেলায় প্রায় ৮ কোটি ২৪ লাখ ৬৫ হাজার ৩২০ টাকার মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হয়েছে। তবে এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি বলে দাবি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও নেত্রকোনা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলাটিতে মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ ৮৪ হাজার ১৬৫ হেক্টর, এতে মাছ উৎপাদন হয় প্রায় ১ লাখ ১০ টন। এর মধ্যে ছোট–বড় ৮৯টি হাওরে ৪০ শতাংশ, খাল-বিল ও নদ-নদীতে ১৫ শতাংশ মাছ উৎপাদিত হয়। বাকি ৪৫ শতাংশ মাছ পুকুরে চাষ করা হয়। জেলায় মোট পুকুরের সংখ্যা ৬০ হাজার ১০২। আর মাছচাষির সংখ্যা ৪৮ হাজার ২৩৮ জন।
জেলাটিতে মোট উৎপাদিত মাছের অর্ধেকই উদ্বৃত্ত থাকে, তা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে গত সপ্তাহে নেত্রকোনার ছোট-বড় সব নদ-নদীর পানি বেড়ে বন্যা দেখা দেয়।
সূত্রগুলো আরও বলছে, বন্যাদুর্গত এলাকায় মৎস্যসম্পদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৩১২ দশমিক ৫৯ হেক্টর জমিতে অন্তত ১ হাজার ৪৮০টি পুকুর এবং খামারের ৭২৩ দশমিক ৪৩ মেট্রিক টন মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। এ কারণে ৮৯৬ জন মাছচাষির প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকারি হিসেবে শুধু মাছেই তাঁদের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ২৪ লাখ ৬৫ হাজার ৩২০ টাকা। এ ছাড়া ভৌত অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে আরও ১ কোটি ২১ লাখ টাকা। তবে চাষিদের দাবি, মৎস্যসম্পদের মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি টাকার বেশি।
বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও সদর উপজেলায়। সদরের ৯৬৩টি ও কলমাকান্দায় ৩২২টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন অনেক মৎস্যচাষি।
যেভাবে পানি বাড়ছে, এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চাওয়া হবে।নেত্রকোনার মৎস্য কর্মকর্তা শাহজাহান কবির
কলমাকান্দার আমতৈল গ্রামের সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি পুকুরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ চাষ করি। বন্যার আশঙ্কায় পুকুরের পাড়ে জাল দিয়ে বেড়া (ঘের) দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। ঢলের তোড়ে জালের বেড়া তো টেকেইনি, পাড়ও ধসে গেছে। চোখের সামনে প্রায় ২৫ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে।’
এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহজাহান কবির বলেন, আকস্মিক বন্যায় মৎস্যসম্পদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তথ্য নিয়ে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় আট কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যেভাবে পানি বাড়ছে, এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চাওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, বন্যায় শুধু পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়া নয়, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বেশ কিছু সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। অসংখ্য মানুষ পানিবন্দী আছেন। ত্রাণসহায়তাসহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, সম্মিলিত সহযোগিতায় এ সংকট সহজে কেটে যাবে।