কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের হাসানপুর রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা মালবাহী ট্রেনকে পেছন যাত্রীবাহী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা ‘সিগন্যাল বিভ্রান্তির’ কারণে বলে বলছেন স্টেশনমাস্টার মাহমুদুল ইসলাম ভূঁইয়া। এই স্টেশনে থাকা তিনজন স্টেশনমাস্টারের একজন তিনি। তবে কী কারণে ও কীভাবে এই দুর্ঘটনা, তা তদন্তে গতকাল রোববার চার সদস্যের কমিটি করেছে রেলওয়ে। এদিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এই ঘটনায় যাত্রীবাহী ট্রেনের চালকসহ তিনজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে।
এই দুর্ঘটনায় সোনার বাংলা ট্রেনের সাতটি বগি ও ইঞ্জিন এবং মালবাহী ট্রেনের দুটি কনটেইনার ও গার্ডরুম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্রেনের বগি দুমড়েমুচড়ে পাশের জমিতে পড়ে যায়। রেললাইনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যাত্রীবাহী ট্রেনের অন্তত ৫০ যাত্রী আহত হলেও কোনো প্রাণহানি না হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন স্থানীয় লোকজন।
আজ সোমবার বেলা ১১টার দিকে হাসানপুর রেলস্টেশনে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসানপুর রেলস্টেশন এলাকায় চারটি রেললাইন। রেলস্টেশনের পশ্চিম পাশের লাইনে মালবাহী ট্রেনটি দাঁড়ানো ছিল। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনটি পাশের লাইন দিয়ে ঢাকার দিকে যাওয়ার কথা। কিন্তু সিগন্যাল পয়েন্ট ঠিক না হওয়ার কারণে সোনার বাংলা পশ্চিম পাশের একই লাইনে ঢুকে পড়ে। এতে করে দুর্ঘটনা ঘটে।
হাসানপুরের স্টেশনমাস্টার মাহমুদুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, সিগন্যাল বিভ্রান্তির কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। ওই সময় বিদ্যুৎ ছিল না। স্টেশনমাস্টার ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সিগন্যাল পয়েন্ট ঠিক করতে যাওয়ার আগেই সোনার বাংলা ট্রেনটি মালবাহী ট্রেনের লাইনে ঢুকে পড়ে।
রেলস্টেশন লাগোয়া মা–বাবার ফার্নিচার দোকানের স্বত্বাধিকারী নুরে আলম বলেন, ‘হঠাৎ বিকট শব্দ হলো। দৌড়ে গিয়ে দেখি, রেললাইন থেকে বগি ছিটকে গেছে। মানুষের চিৎকার। কিন্তু এত বড় দুর্ঘটনায় আল্লাহর রহমতে কেউ মারা যায়নি।’
নাঙ্গলকোটের হোচইর গ্রামের আবু ইউসুফ বলেন, ‘দুর্ঘটনার ১৫ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে আসি। ইফতারের সময় সবাই সজাগ ছিলেন, তাই প্রাণহানি হয়নি।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, সোনার বাংলা ট্রেনের ক্ষতিগ্রস্ত বগি রেললাইন উপড়ে পশ্চিম পাশের খেতে পড়ে আছে। ইঞ্জিন আর দুমড়েমুচড়ে যাওয়া ছয়টি বগি এলোমেলো পড়ে আছে। দুটি বগি রেললাইনে আছে। মালবাহী ট্রেনের গার্ডরুম, দুটি কনটেইনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাত ১টা ২০ মিনিটে লাকসাম থেকে উদ্ধারকারী হাইড্রোলিক রিলিফ ট্রেন আসে। লাকসাম রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী মো. সোলায়মান বলেন, ‘মালবাহী ট্রেনের কনটেইনার সরাচ্ছি আমরা।’
এদিকে আখাউড়া থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে পৌঁছায় আজ সোমবার সকাল ৮টা ২০ মিনিটে। আখাউড়ার ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী মনির উদ্দিন বলেন, ‘এখন আমরা বগি সরাচ্ছি সোনার বাংলা ট্রেনের। রেললাইন মেরামত করছি।’
দুর্ঘটনার বিষয়টি তদন্তে রেলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা তারেক মুহাম্মদ ইমরানকে প্রধান করে কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) মো. জাহিদ হাসান, বিভাগীয় সংকেত প্রকৌশলী জাহেদ আরেফিন পাটোয়ারী ও বিভাগীয় প্রকৌশলী-১ এমএ হাসান মুকুল। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
কমিটি গঠনের বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন কমিটির প্রধান তারেক মুহাম্মদ ইমরান। তিনি বলেন, তাঁরা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দেবেন।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কারও গাফিলতি পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুর্ঘটনার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে রাত ৯টার দিকে আবার ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
দুর্ঘটনায় সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের চালক (লোকোমাস্টার) মো. জসিম উদ্দিন, সহকারী লোকোমাস্টার মো. মহসীন ও গার্ড আবদুল কাদেরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানান রেলওয়ের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী (লোকো) মো. জাহিদ হাসান। তিনি বলেন, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের নির্দেশে দায়িত্বে অবহেলার কারণে তিনজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। যেই স্টেশনমাস্টার ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সিগন্যাল পয়েন্ট ঠিক করতে গিয়েছিলেন, তাঁর ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।