ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে গিয়ে হাত ভেঙেছিল। ব্যান্ডেজ করা হাত ঝুলিয়ে রাখতে হয়েছিল দুই মাসের মতো। তখন এক আত্মীয়ের বাড়িতে পারিবারিক অনুষ্ঠান ছিল। কিন্তু হাত ভাঙা থাকায় তাঁকে সেই অনুষ্ঠানে নেওয়া হয়নি। ঘটনাটি তাঁর মনে দাগ কাটে। তখন তাঁর বয়স ছিল ১১ কি ১২ বছর।
ছোটবেলার সেই ঘটনাই তাঁকে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করার উৎসাহ জুগিয়েছে। এখন তিনি তাঁর এলাকার আশপাশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার প্রতিবন্ধীদের সহযোগিতা করেন। প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার খরচ বহন করা, শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, হুইলচেয়ারসহ সহায়ক উপকরণ দেওয়া, ঘর বানিয়ে দেওয়ার মতো কাজ করছেন তিনি নিজের টাকায়।
১৮ বছর ধরে প্রতিবন্ধীদের সেবা করে যাচ্ছেন। এখন তাঁর তথ্যভান্ডারে ২৫০ জনের মতো প্রতিবন্ধীর নাম রয়েছে, যাঁদের তিনি নানাভাবে সহযোগিতা করছেন।
প্রতিবন্ধীদের পরম বন্ধু এই মানুষটির নাম কাগজী মো. আরিফুজ্জামান। সবাই তাঁকে তুহিন কাগজী নামে চেনেন। পেশায় তিনি ঘের ব্যবসায়ী। বাড়ি খুলনার পাইকগাছা উপজেলার লস্কর ইউনিয়নের লস্কর গ্রামে। লস্কর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) তিনবারের চেয়ারম্যান তিনি।
আরিফুজ্জামানের নানার বাড়ি পাইকগাছার পাশের উপজেলা কয়রার বাগালী গ্রামে। ২০০৫ সালের মাঝামাঝি কোনো একদিন নানাবাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে ফিরছিলেন তিনি। পথে পাইকগাছার চাঁদখালী ইউনিয়নের গজালিয়া এলাকায় দেখতে পান, এক মা তাঁর প্রতিবন্ধী মেয়েকে কোলে করে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, প্রতিদিন প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের স্কুলে সেই মা তাঁর তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে তাসলিমা খাতুনকে কোলে করে দিয়ে আসেন, আবার নিয়ে আসেন। কিছুদিন পর ওই মেয়েকে একটি হুইলচেয়ার কিনে দেন আরিফুজ্জামান। তাঁর লেখাপড়ার দায়িত্বও নেন তিনি। সেই থেকে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আরিফুজ্জামানের পথচলা শুরু। তাসলিমা খাতুন এখন পাইকগাছা সরকারি কলেজে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়েন।
সম্প্রতি কথা হয় তাসলিমার সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর বাবা দিনমজুর ছিলেন। এখন অসুস্থ থাকায় কাজ করতে পারেন না। তাসলিমা বলেন, ‘জন্ম থেকেই দুই পা অচল, হাঁটতে পারি না। ছোটবেলায় অন্যদের স্কুলে যেতে দেখে আমাকেও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার বায়না ধরেছিলাম। তখন বাড়ির আশপাশের অনেকেই আমার মা–বাবাকে নিষেধ করেছিলেন আমাকে স্কুলে ভর্তি করতে। পরে দেখা যায়, আমি স্কুলে প্রথম হয়েছি। তুহিন কাকুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন সব খরচ তিনিই বহন করেন। তিনি না থাকলে এতদূর আসতে পারতাম না।’
তাসলিমার মতো আরও ১৫-১৬ জনের পড়ার খরচ দেন আরিফুজ্জামান। এ ছাড়া ১০ জন প্রতিবন্ধীকে ঘর বানিয়ে দিয়েছেন, হুইলচেয়ার দিয়েছেন ১২০ জনকে, শ্রবণযন্ত্র দিয়েছেন প্রায় ৬০ জনকে, পড়াশোনার খরচ দিচ্ছেন ১৬ জনকে, বছরে বই-খাতা কিনে দেন ৩০ জনকে, তিনজনকে কৃত্রিম পা বানিয়ে দিয়েছেন এই জনপ্রতিনিধি। তাঁর কাজের বিস্তৃতি পাইকগাছা উপজেলাসহ খুলনা ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলায়।
জানতে চাইলে লক্ষ্মীখোলা কলেজিয়েট স্কুলের অধ্যক্ষ কে এম মেসবাহুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এই এলাকায় যাঁরা প্রতিবন্ধী আছেন, তাঁরা সমাজে অবহেলিত ছিলেন। তাঁদের মা–বাবারাও সন্তানদের নিয়ে হতাশ ছিলেন। আরিফুজ্জামান প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করার ফলে ওই এলাকার মানুষ সচেতন হয়েছেন। প্রতিবন্ধীদের আর অবহেলার চোখে দেখেন না।
খায়রুল ইসলামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গোয়ালডাঙ্গা গ্রামে। খুলনা বিএল কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় দিন দিন চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন, বাড়িতেই থাকতেন। বছরখানেক আগে তাঁকে একটি কম্পিউটার কিনে দিয়ে গোয়ালডাঙ্গা বাজারে দোকান করে দেন আরিফুজ্জামান। এখন সেই দোকান থেকে আয় করেই সংসারের খরচ মেটান খায়রুল।
২০২০ সালে করোনার মধ্যে আখলাস নামের ১৪-১৫ বছর বয়সী এক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছেলে পথ ভুলে পাইকগাছায় চলে আসে। পোশাক-পরিচ্ছদ ভালোই ছিল তার। স্থানীয় লোকজন ছেলেটিকে আরিফুজ্জামানের কাছে দিয়ে আসেন। তিনি প্রায় তিন মাস নিজের বাড়িতে রাখেন ছেলেটিকে। তার পরিবারের সন্ধান পেতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালান। একসময় পরিবারের সন্ধান পেয়ে যান। ছেলেটিকে তুলে দেন স্বজনদের হাতে।
পাইকগাছা উপজেলা সদর ইউনিয়নে বাড়ি সুভাষ চন্দ্র মণ্ডলের। দুই পা অচল তাঁর। ইংরেজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে তিনি এখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রধান অতিথি হিসেবে রাখেন আরিফুজ্জামান। সুভাষ চন্দ্র বলেন, ‘আমাকে দেখে অন্য প্রতিবন্ধীরা যেন উৎসাহিত হন, এ কারণে আমাকে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করে রাখা হয়। কোথাও কোনো প্রতিবন্ধী কষ্ট পাচ্ছেন শুনলেই সেখানে দৌড়ে যান আরিফুজ্জামান।’
এক প্রশ্নের জবাবে আরিফুজ্জামান বলেন, তাঁর ও তাঁর পরিবারের মালিকানায় প্রায় ৩০০ বিঘা মাছের ঘের আছে। পাইকগাছা বাজারে একটি মাছের আড়ত রয়েছে। এসব থেকে যে আয় আসে, তার একটা অংশ দিয়ে প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করেন তিনি।
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে আরিফুজ্জামানকে। আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকেও বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। অনেকেই তাঁকে ‘পাগল’ বলেও সম্বোধন করতেন। কিন্তু দমে যাননি তিনি। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে নিজস্ব স্লোগান বানিয়েছেন—‘প্রতিবন্ধীরা প্রতিভাবন্দী নয়, ওরাও মানুষ’। গড়ে তুলেছেন ‘কাগজী প্রতিবন্ধী কল্যাণ ট্রাস্ট’।
পাইকগাছা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে সাত বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন সরদার আলী আহসান। গত আগস্টে তিনি অন্য উপজেলায় বদলি হয়ে যান। আলী আহসান প্রথম আলোকে বলেন, সমাজসেবা কার্যালয় থেকে প্রতিবন্ধীদের যে সহযোগিতা করা হয়, তা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। সে ক্ষেত্রে আরিফুজ্জামান প্রতিবন্ধীদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় প্রতিবন্ধীদের খুব উপকার হয়।
তিন ভাই-বোনের মধ্যে আরিফুজ্জামান মেজ। বড় ভাই অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, পরিবারসহ থাকেন জার্মানিতে। ছোট বোন থাকেন ঢাকায়। আর তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরা খুলনা শহরে থাকলেও শুধু তিনিই পড়ে আছেন অজপাড়াগাঁয়ে। খুলনা শহর থেকে ওই ইউনিয়নের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার।
আরিফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেদিন কোনো প্রতিবন্ধীর সহায়তায় কাজ করতে পারি, সেদিন রাতেই সবচেয়ে ভালো ঘুম হয়। এখন আমার নেশা বা পেশা একটাই; আর তা হলো, প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করতে পারা।’