অদম্য মেধাবী ২০২৩ : ১২

সবার মধ্যে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন

জান্নাতুন আক্তার , আশিক ইসলাম, নাহিদ ইসলাম, রনি ইসলাম
জান্নাতুন আক্তার , আশিক ইসলাম, নাহিদ ইসলাম, রনি ইসলাম

চোখের সামনে ক্যানসারে আক্রান্ত বাবার মৃত্যু দেখেছে জান্নাতুন। কারখানার শ্রমিক বাবার মৃত্যুর পর অসহায় হয়ে পড়ে পরিবারটি। তাদের কোনো জমিজমা নেই। মা করিমা আক্তার বিধবা ভাতা ও সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালান। এভাবেই সন্তানের পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছেন তিনি। দারিদ্র্যের বাধা পেরিয়ে ভবিষ্যতে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখছে জান্নাতুন। একইভাবে সংগ্রাম করছে জান্নাতুনের সহপাঠী আশিক ইসলাম, নাহিদ ইসলাম ও রনি ইসলাম।

এই চার শিক্ষার্থী শত প্রতিকূলতার মধ্যে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় নীলফামারীর ডোমার উপজেলার খাটুরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাদের সবার মধ্যে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন।

চিকিৎসক হতে চায় জান্নাতুন

২০২০ সালে চিকিৎসার অভাবে ক্যানসারে আক্রান্ত বাবার মৃত্যুর পর থেকে জান্নাতুনের স্বপ্ন, সে বড় হয়ে চিকিৎসক হবে। সে খাটুরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। জান্নাতুনদের বাড়ি ডোমার উপজেলার খাটুরিয়া গ্রামে। দুই ভাই-বোনের মধ্যে জান্নাতুন ছোট। জান্নাতুন আক্তার বলে, ‘আমি চিকিৎসক হয়ে দেশের জন্য কিছু করতে চাই। আমি আমার আব্বুকে ক্যানসারে মারা যেতে দেখেছি। আর যেন কোনো বাবা এভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা না যান।’

জান্নাতুনের মা কারিমা আক্তারের সামান্য আয়ে তাদের সংসার চলে। তিনি বলেন, ‘সেলাইয়ের কাজ করে যে আয় হয়, তাতে সংসার চলে না। এত দিন জান্নাতুন বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছে। বাইরে পড়ানোর মতো সামর্থ্য আমার নেই। কীভাবে পড়াশোনা চলবে, বুঝতে পারছি না।’

মায়ের দুঃখ ঘোচাতে চায় আশিক

বাবা মারা গেছেন। নিজেদের কোনো জমিজমা নেই। মা লাভলী বেগম কৃষিকাজ করে সংসার চালান। মায়ের দিনমজুরের টাকা দিয়ে পড়ালেখা করেছে আশিক ইসলাম। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় খাটুরিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।

আশিক খাটুরিয়া গ্রামের ডাঙ্গাপাড়ার মৃত আতিয়ার রহমানের ছেলে। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে আশিক দ্বিতীয়। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। আশিক ইসলাম বলে, ‘আমি ভবিষ্যতে প্রকৌশলী হতে চাই। চাকরি করে মায়ের কষ্ট দূর করব। আমাদের মতো পরিবারের শিক্ষার্থীদের কষ্ট আমি বুঝি। বড় হয়ে আমার মতো অসহায় শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করতে চাই।’

মা লাভলী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দিনমজুরি করে যে টাকা পান, তাতে দুই বেলা খাবার জোটে না। ছেলে এখন কলেজে পড়তে চায়। কিন্তু কীভাবে কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না।

পড়ার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় নাহিদ

নাহিদ ইসলামের নিজেদের জমিজমা নেই। বাবার মৃত্যুর পর চাচা দুই শতক জমি দান করেন। সেই জমিতে একটি ঘর করে দিয়েছে সরকার। মা নেহার বেগম দিনমজুরি করে সংসার চালানোর পাশাপাশি ছেলের পড়ালেখার খরচ দেন। নাহিদ এবারের এসএসসি পরীক্ষায় খাটুরিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতের লেখাপড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে সে।

নাহিদ খাটুরিয়া গ্রামের মৃত রহিম উদ্দিনের ছেলে। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে নাহিদ সবার ছোট। তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের ঘরে এক ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে বসবাস করেন নেহার বেগম। নাহিদ ইসলাম বলে, ‘আমার বাবা ২০০৫ সালে মারা যান। আমাদের নিজের কোনো জমিজমা নেই। চাচা জসিম উদ্দিন ২ শতক জমি দান করেছেন। সরকার সেখানে ঘর তুলে দিয়েছে। আমরা ২ বছর ধরে সেখানে বসবাস করছি। আমি একজন চিকিৎসক হতে চাই। এ জন্য আমাকে আরও অনেক পড়াশোনা করতে হবে। কিন্তু পড়াশোনার খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

বুয়েটে পড়তে চায় রনি

খাটুরিয়া গ্রামের তেলিপাড়ার মো. রনি ইসলাম খাটুরিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার বাবা আবদুর রহিম পেশায় ভ্যানচালক। মা মঞ্জিলা বেগম গৃহিণী। উচ্চমাধ্যমিক ভর্তির জন্য রনির প্রথম পছন্দ ছিল ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজ। সেখানে নামও আসে তার। কিন্তু অর্থাভাবে সেটি বাতিল করেছে সে।

রনি প্রথম আলোকে বলে, ‘আমি বুয়েটে পড়াশোনা করে একজন প্রকৌশলী হতে চাই। প্রকৌশলী হয়ে দেশের কাজে লাগতে চাই। কিন্তু আমার বাবার সামর্থ্য নেই। আগামী দিনের পড়ালেখা কীভাবে চলবে, জানি না।’

খাটুরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোফাজ্জল হোসেন শাহ প্রথম আলোকে বলেন, জান্নাতুন, আশিক, নাহিদ, রনিসহ তাঁর বিদ্যালয় থেকে এবার ২৫ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। ওই শিক্ষার্থীদের পরিবারগুলো খুবই অসচ্ছল। তাঁরা শিক্ষকেরাও অনেক সহযোগিতা করেছেন। ওই বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রামকৃষ্ণ রায় বলেন, ‘চারজনেরই পরিবার অনেক গরিব। আমরা বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছি। এখন কেউ সহযোগিতা দিলে নিশ্চয়ই তারা স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।’

ওই শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পড়িয়েছেন স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুভাষ রায়। তিনি বলেন, তারা অনেক মেধাবী ও গরিব। তারা ভালো করেছে। কারও সহযোগিতা পেলে ভবিষ্যতে তারা আরও ভালো করতে পারবে।