পাহাড়ি–বাঙালি সংঘাতের পর খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে। খাগড়াছড়ির পর গতকাল রোববার রাঙামাটি থেকেও ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়া হয়েছে। অবশ্য অবরোধ ও পরিবহন ধর্মঘটের কারণে গতকালও দুই জেলায় ছিল অচলাবস্থা। এদিকে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে নিহত দুজনের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, খাগড়াছড়িতে গণপিটুনিতে একজন নিহত হওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। একপর্যায়ে সেখানে পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পরে রাতে জেলা সদরে গোলাগুলিতে ৩ জন নিহত ও ২০ জন আহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন রাঙামাটিতে আয়োজিত প্রতিবাদ মিছিলে ঢিল ছোড়াকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১ জন নিহত ও ৬০ জন আহত হন।
পাহাড়ি–বাঙালি সংঘর্ষের ঘটনায় শুক্রবার দুপুরে রাঙামাটি পৌর এলাকায় জারি করা ১৪৪ ধারা জারি তুলে নেওয়া হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টা থেকে এই ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান গতকাল সকালে প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি এখন অনেকটা স্বাভাবিক। তাই রোববার বেলা ১১টা থেকে ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়া হয়।
এর আগে শুক্রবার রাত ৯টার পর খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারার মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। সেখানে শুক্রবার দুপুরে এ বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছিল।
৭২ ঘণ্টার অবরোধের কারণে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে গতকালও দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। খোলেনি অধিকাংশ দোকানপাট। আজ সোমবার অবরোধ শেষ হবে।
পাহাড়ের সংঘাতের প্রতিবাদে শুক্রবার চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে তিন পার্বত্য জেলায় ৭২ ঘণ্টার এ অবরোধের ডাক দেওয়া হয়।
অবরোধের দ্বিতীয় দিনে গতকাল খাগড়াছড়ি থেকে দূরপাল্লার কোনো যানবাহন ছেড়ে যায়নি। তবে খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা চত্বর, আদালত সড়ক, বাস টার্মিনাল, চেঙ্গি স্কয়ার, মধুপুর সড়কসহ আশপাশের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
রাঙামাটিতেও পরিবহন ধর্মঘট ও অবরোধের কারণে সাধারণ মানুষের যাতায়াতে চরম ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে রাঙামাটি শহরে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তেমন মানুষ বের হননি। সকাল থেকে শহরে কোনো যানবাহন চলাচল করেনি।
রাঙামাটি-চট্টগ্রাম, রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি-কাপ্তাই-বান্দরবান রুটেও দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলাচল করেনি। তবে বান্দরবানে অবরোধের প্রভাব পড়েনি।
অবরোধের পাশাপাশি রাঙামাটিতে শনিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘটও চলছে। শুক্রবার যানবাহন ভাঙচুরের প্রতিবাদে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়। জানতে চাইলে পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, দ্বিতীয় দিনের মতো সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে মো. মামুন (৩০) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে।
১৯ সেপ্টেম্বর মামুনের স্ত্রী মুক্তা আক্তারের করা মামলায় মো. শাকিল, রফিকুল আলম ও দিদারুল আলম নামের তিনজনের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া মামলায় ১০-১২ জন অজ্ঞাতনামা ‘উপজাতি ও বাঙালি’র কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
আসামি রফিকুল আলম আওয়ামী লীগের নেতা ও খাগড়াছড়ি পৌরসভার সাবেক মেয়র। আরেক আসামি দিদারুল তাঁর ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং মো. শাকিল আওয়ামী লীগের নেতা। তাঁরা তিনজনই গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে পলাতক।
মুক্তা আক্তার গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামীকে হত্যার পেছনে বাঙালি ও পাহাড়ি—দুই পক্ষই আছে। পাহাড়িদের তিনি চিনেননি। তাই তাদের নাম দেননি।
আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের আসামি করার বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তা আক্তার বলেন, ‘আমি তো বলি নাই তারা মেরেছে। তবে সন্দেহ হয়, তারা জড়িত।’
এদিকে রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতে একজনের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে। রাঙামাটির কোতোয়ালি থানায় মামলাটি করেন নিহত কলেজছাত্র অনিক কুমার চাকমার বাবা আদর সেন চাকমা। মামলায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।
রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহ মো. ইমরান প্রথম আলোকে মামলার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, রাঙামাটিতে শুক্রবারের সহিংসতা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।
গতকাল বিকেলে জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে সম্প্রীতি সমাবেশ হয়েছে। জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত সম্প্রীতি সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সদর সেনা জোনের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. এরশাদ হোসেন চৌধুরী, পুলিশ সুপার এস এম ফরহাদ হোসেন, সিভিল সার্জন নূয়েন খীসাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা।