অনেকের চোখে পানি; মুখে যন্ত্রণা আর হতাশার ছাপ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে কেউ কেউ দেখছেন ধসে পড়া রানা প্লাজার স্মৃতিচিহ্ন। কারও কণ্ঠে ক্ষোভ। তাঁরা প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শহিদ বেদিতে রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। আজ বুধবার সকালে ঢাকার সাভার বাসস্ট্যান্ড–সংলগ্ন এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে গিয়ে এই দৃশ্য দেখা যায়।
নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সবার প্রশ্ন, ঘটনার ১১ বছর পূর্ণ হয়েছে। কবে তাঁদের দাবি আদায় হবে, দোষী ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, সাভার উপজেলার বড় ওয়ালিয়া গ্রামের কিশোর রিহান শেখকে। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে তার মা–বাবা দুজনই নিহত হন। ওই সময় তার বয়স ছিল ছয় মাস। কয়েক বছর ধরে এই দিনটিতে রানা প্লাজার সামনে আসে নিহত মা–বাবাসহ অন্যদের শ্রদ্ধা জানাতে।
রিহান শেখ প্রথম আলোকে বলে, ‘আমার মা–বাবা নেই। খালা-খালুর সঙ্গে থাকি। আগে নানির সঙ্গে ছিলাম। যাদের কারণে আমার মা–বাবা মারা গেছে, তাদের বিচার চাই।’
ক্রাচে ভর করে ধসে পড়া রানা প্লাজার জায়গাটি দেখছিলেন আহত শ্রমিক ইয়ানুর বেগম (২৩)। ঘটনার দিন ভবনটির ছয়তলার একটি কারখানায় ছিলেন তিনি। ইয়ানুর বলেন, ‘দুই পায়ে ছয়টি অপারেশন করতে হইছে। আমাদের সহায়তার নামে ভিক্ষা দিছে। যারা আহত আছি, তাদের যে যা কাজ পারবে, সেই কাজ দিক। আমরা কাজ করে বাঁচি। কেউ কোনো খোঁজ নেয় না। যাদের কারণে আমরা পঙ্গু হইছি, তাদের বিচার হয় নাই। এখন মনে হয় নিজে খুন করি, এরপর দেখি কী বিচার হয়।’
আহত নিলুফা বেগম বলেন, ‘ঘটনার পর ৯ ঘণ্টা আটকা ছিলাম। ডান পায়ে ব্যথা পাই। অপারেশন করা লাগছে। পা কেটেও ফেলতে চাইছিলাম। পায়ের হাঁটু পর্যন্ত একটা বেল্ট লাগাইয়া হাঁটতে হয়। ক্ষতিপূরণ পাইছি ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এখন আর কেউ আমাদের কোনো খোঁজখবর নেয় না। ওই ঘটনার পর স্বামী চলে গেছে। চিন্তায় মা স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ) করে মারা গেছে। ভীষণ কষ্টে আছি।’
এদিকে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা, শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায় না হওয়ার জন্য সরকারের সদিচ্ছাকে দায়ী করছেন। তাঁরা নিহত ব্যক্তির পরিবারকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশন অনুযায়ী এক জীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ, আহত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসা, ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনা একটি হত্যাকাণ্ড। এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) কনভেনশন অনুযায়ী এক জীবনের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সরকারকে আহত ব্যক্তিদের সামর্থ্য অনুসারে কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খাইরুল মামুন জানান, রানা প্লাজা ধসের এই দিনে নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরা ও আহত শ্রমিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠানে আসেন। শ্রমিক সংগঠনগুলো দিবসটি স্মরণ করে নানা আয়োজন করে। তিনি বলেন, ‘রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১১ বছরে এসেও আমাদের দাবি পূরণ হয়নি। আহত ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসন, সুচিকিৎসা ও ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত বিচার করতে হবে।’
সকালে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শহিদ বেদিতে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, ল্যাম্পপোস্ট, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সাভার শাখা, গণমুক্তির গানের দল, শিল্প পুলিশ, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল-গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগ, গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (জী-স্কপ), গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি, এশিয়া ফ্লোর ওয়েজ অ্যালায়েন্স, বাংলাদেশ জোট প্রভৃতি।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল আটতলা রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১০০ জন নিহত ও ২ হাজার ৫০০ জন আহত হন। এই বহুতল ভবনে পাঁচটি গার্মেন্টস কারখানায় পাঁচ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করতেন।