খাঁচার ভেতরে পেখম তুলে নাচছে ময়ূর। তা দেখতে ভিড় লেগে গেছে দর্শনার্থীদের। কারণ, ‘ভাগ্য ভালো’ হলে এই দৃশ্যের দেখা মেলে। আবার বাঘের খাঁচার সামনেও বড় জটলা। সাদা বাঘ দেখে সে কী উচ্ছ্বাস! আজ শুক্রবার বিকেলে এই দৃশ্য চোখে পড়ে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায়।
বাঘের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে বাবার কাছে নানা ধরনের প্রশ্ন করছিল ৯ বছরের শিশু তিয়াস দেবনাথ। চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ কাট্টলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। বাবার কাছে তার প্রশ্ন, সে বইয়ে দেখেছে কেবল হলুদ-কালো ডোরাকাটা বাঘ। খাঁচার ভেতরে কিছু বাঘ সাদা-কালো ডোরাকাটা কেন। তিয়াসকে বাঘের খাঁচার সামনে থেকে সরাতে বেশ বেগ পেতে হয় তার বাবাকে। বাঘ দেখেই যেন সে আনন্দ পেয়েছে সবচেয়ে বেশি।
বাঘের মতো ভালুকের খাঁচার সামনেও মানুষের জটলা। নিজের ছেলে-মেয়েদের সেখানে ভালুক দেখাচ্ছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল নোমান। তিনি বলেন, ভালুক দেখে ছেলে-মেয়েরা খুব আনন্দ পেয়েছে। তবে ভালুকের জন্য খাঁচাটি বেশ ছোট, খাঁচাটি বড় হলে ভালুকটির হাঁটাচলায় সুবিধা হতো। দর্শনার্থীরাও ভালোভাবে ভালুক দেখতে পারতেন।
কিছু দূর এগোতেই জেব্রার একটি খাঁচার সামনে কথা হয় চকবাজারের বাসিন্দা সাহাব উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট। চিড়িয়াখানায় এসেছেন চার বছরের নাতি জারিফ নাওয়ারকে নিয়ে। চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি। চিড়িয়াখানায় কেমন লেগেছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কয়েক বছরে চিড়িয়াখানার পশুপাখি ও সৌন্দর্য অনেক বেড়েছে। তবে হাতি ও জিরাফ না দেখে তাঁর নাতির একটু মন খারাপ। ইন্টারনেটে ভিডিও দেখে নাতি এই দুটি প্রাণী চিনেছে, ভেবেছিল চিড়িয়াখানায়ও হাতি-জিরাফ দেখা যাবে।
হাতি-জিরাফ না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর শাহাদাত হোসেন শুভ বলেন, চিড়িয়াখানাকে সমৃদ্ধ করতে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রাণী নিয়ে আসা হচ্ছে। হাতি-জিরাফও কীভাবে চিড়িয়াখানায় আনা যায়, এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।
তিনি বলেন, চিড়িয়াখানায় জলহস্তীও নেই। ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে এক জোড়া জলহস্তী আনার প্রক্রিয়া প্রায় শেষের দিকে। চলতি মাসেই জলহস্তীগুলো পাওয়া যাবে। এর বিনিময়ে রংপুর চিড়িয়াখানাকে এক জোড়া বাঘ দিতে হবে।
২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এক জোড়া বাঘ আনে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। বাঘের নাম দেওয়া হয় রাজ, আর বাঘিনীর নাম পরি। এই বাঘ দম্পতির ঘরে জন্ম নেওয়া ১৪টি শাবক মিলিয়ে এখন চিড়িয়াখানায় বাঘের সংখ্যা ১৬। এর মধ্যে পাঁচটি বিরল সাদা বাঘ।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চিড়িয়াখানাটির ৩৫টি খাঁচায় রয়েছে ৬৬ প্রজাতির ৬২০টি প্রাণী। চিড়িয়াখানায় প্রতিবছরই নতুন নতুন প্রাণী সংযোজিত হচ্ছে। গত মার্চে চিড়িয়াখানাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এক জোড়া সিংহ ও চার জোড়া ওয়াইল্ড বিস্ট আনা হয়। এর আগের বছর হল্যান্ড থেকে কিনে আনা হয় ছয়টি ক্যাঙারু ও ছয়টি লামা। এ ছাড়া একই বছর আনা হয়েছে বেশ কয়েকটি ম্যাকাও পাখি।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি স্বল্প পরিসরে চিড়িয়াখানাটির যাত্রা শুরু হয়। তখন ভালুক, হরিণ, বানরসহ ছয়-সাতটি প্রজাতির প্রাণী নিয়ে চিড়িয়াখানাটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। প্রাণীগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ আনা হয় বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তির সংগ্রহশালা থেকে।
উদ্বোধনের সময় প্রায় পাঁচ একর জায়গা নির্ধারণ করা হলেও পশুপাখি কম থাকায় চিড়িয়াখানাটির আড়াই একরের মতো জায়গা ব্যবহৃত হতো। পরে দর্শনার্থী বাড়ায় চিড়িয়াখানাটি সম্প্রসারণ করা হয়। এখন ১০ দশমিক ২ একর ভূমিতে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা অবস্থিত। তবে পশুপাখি বাড়ার কারণে এরপরও জায়গার সংকুলান হচ্ছে না বলে দাবি কর্মকর্তাদের।
চিড়িয়াখানাটিতে পশুপাখির খাঁচার বাইরে শিশুদের বিনোদনের রয়েছে কিডস জোন। সেখানে ফ্রিতে দোলনা, স্লাইডসহ বিভিন্ন রাইডের সুযোগ রাখা হয়েছে শিশুদের জন্য।
ছয় মাসে সাড়ে তিন কোটি টাকা আয়
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় ৯-১০ বছর আগেও প্রতিদিন ৬০০-৭০০ দর্শনার্থীর দেখা মিলত। এখন তা বেড়ে তিন হাজার ছাড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতি মাসে এখন গড়ে এক লাখ দর্শনার্থী চিড়িয়াখানায় আসেন। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন চিড়িয়াখানা ঘুরতে আসেন ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ দর্শনার্থী। তবে শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনে অনেক সময় দর্শনার্থী ১০ হাজারের বেশি হয়। দর্শনার্থীরা ৭০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করেন।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার আয়ের হিসাব ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২১ সালে টিকিট বিক্রি করে ৩ কোটি ২১ লাখ টাকা আয় হয়েছে। পরের বছর ২০২২ সালে আয় ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসেই টিকিট বিক্রি করে আয় হয়েছে ৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার তহবিলে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে ছিল মাত্র ৪ হাজার ৮৯৪ টাকা। ৯ বছরের ব্যবধানে সেই তহবিলে এখন রয়েছে ৬ কোটি ৫ লাখ টাকা। এর বাইরে প্রতিষ্ঠানের অর্জিত আয় থেকেই পশুপাখি কেনাসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এই সময়ের মধ্যে ব্যয় হয়েছে ১০ কোটি ৫ লাখ ৯৯ হাজার টাকা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চিড়িয়াখানার তহবিলে থাকা ৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকার মধ্যে আড়াই কোটি টাকা স্থায়ী আমানত হিসেবে ব্যাংকে রাখা হয়েছে। বাকি টাকা তহবিলে জমা রয়েছে। এটিই দেশের একমাত্র চিড়িয়াখানা, যা সরকারি কোনো অনুদান ছাড়া নিজেদের আয়ে পুরোপুরি পরিচালিত হচ্ছে।
বাড়ছে প্রজনন
২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় কোনো বাঘ ছিল না। ২০১৬ সালে ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাঘ কেনা হয়। সেই বাঘ দম্পতি থেকে ১৪টি শাবকের জন্ম হয়। এতে বাঘের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬।
শুধু বাঘেরই প্রজনন বাড়েনি, চিড়িয়াখানাটিতে কৃত্রিম উপায়ে ফোটানো হচ্ছে অজগরের বাচ্চা। ২০১৯ সাল থেকে এরই মধ্যে চার দফায় হাতে তৈরি ইনকিউবেটরে ৮০টি অজগরের বাচ্চা ফোটানো হয়েছে। এর মধ্যে ৮০টি সংরক্ষিত বনে অবমুক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ১৬টি অজগরের বাচ্চা চট্টগ্রামের চুনতি অভয়ারণ্যে ছাড়া হয়।
অতি বিপন্ন হলুদ কাছিম সংরক্ষণেও কাজ করছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। ২০১৩ সাল থেকে সাতটি হলুদ কাছিম রয়েছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায়। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীটি টিকিয়ে রাখতে প্রজননের লক্ষ্যে গত বছর বিশেষ খাঁচা নির্মাণ করা হয়। খাঁচায় আসার পর গত মাসে কাছিমের ডিম থেকে তিনটি হলুদ কাছিমের জন্ম হয়েছে। পাহাড়ি হলুদ কাছিমের আরও বংশবৃদ্ধির পর সেগুলো বন্য পরিবেশে অবমুক্ত করা হবে।
এর বাইরে আবদ্ধ পরিবেশে চিতা বিড়ালের প্রজনন নিয়েও কাজ করছে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। এরই মধ্যে কয়েকটি চিতা বিড়ালের জন্ম হয়েছে চিড়িয়াখানাটিতে।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই, চিড়িয়াখানা যেন কেবল বিনোদনের স্থান না হয়। এ লক্ষ্যেই বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন প্রাণী রক্ষা ও তাদের বংশবিস্তারের চেষ্টা চলছে।’
বাঘের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে চিড়িয়াখানায় এত বাঘের জায়গা হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চিড়িয়াখানায় থাকা বাঘগুলোর জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা চলছে। সুন্দরবনের বাঘগুলোর সঙ্গে জিনগত বড় কোনো পার্থক্য পাওয়া না গেলে চিড়িয়াখানার বাঘগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বনাঞ্চলে ছাড়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সপ্তাহে এক দিন বিনা মূল্যে প্রবেশ
চট্টগ্রামের সুবিধাবঞ্চিত বিভিন্ন এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সপ্তাহে এক দিন করে বিনা মূল্যে চিড়িয়াখানায় প্রবেশের সুযোগ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। বন্য প্রাণী বিষয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ২০১৯ সাল থেকে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
চিড়িয়াখানা সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত বিভিন্ন স্কুলের ৭০০ শিক্ষার্থী বিনা মূল্যে চিড়িয়াখানায় প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে। তাদের প্রত্যেককেই বন্য প্রাণী বিষয়ে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সচেতনতামূলক লিফলেটসহ বিভিন্ন প্রকাশনাও তাদের বিতরণ করা হয়।