পিরোজপুরের নাজিরপুরে কঙ্কাল উদ্ধারের ঘটনায় বেনামি চিঠির রহস্যের জট খোলেনি। নিখোঁজ স্কুলছাত্রী লামিয়া আক্তারের (১৮) পরিবারের দাবি, চিঠির হাতের লেখার সঙ্গে লামিয়ার স্বামী তরিকুল ইসলামের হাতের লেখার মিল রয়েছে। অবশ্য পুলিশ বলছে, বেনামি চিঠির মাধ্যমে তরিকুল লামিয়ার লাশের সন্ধান দেবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
ওই বেনামি চিঠির সূত্র ধরে গত সোমবার বেলা ১১টার দিকে উপজেলার সাতকাছিমা গ্রামের মোজাহার মোল্লার বাড়ির পাশে বালু দিয়ে ভরাট করা একটি জমিতে পুঁতে রাখা কঙ্কাল উদ্ধার করে পুলিশ। তবে লাশটি চার মাস ধরে নিখোঁজ কলেজছাত্রী লামিয়া আক্তারের (১৮) কি না, তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। পরিবারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বিকেলে কঙ্কাল তাঁদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এরপর বাড়িতে জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়। নিখোঁজ লামিয়া আক্তার চিথলিয়া গ্রামের নজরুল ইসলামের মেয়ে এবং স্থানীয় সরকারি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মহিলা মহাবিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন।
নাজিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ময়নাতদন্তের পর লামিয়ার পরিবারের দাবি অনুযায়ী তাঁদের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার পর লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে লাশের চুলের বেণি দেখে পরিবারের সদস্যরা লাশটি লামিয়ার বলে নিশ্চিত করেছেন। এ ঘটনায় আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। মূল আসামি গ্রেপ্তার হলে হত্যার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার তরিকুলের খালা রেক্সনা বেগম (৪০) হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কোনো তথ্য দেননি।
লামিয়া আক্তারের খালা সাবিনা বেগম বলেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেনে না নেওয়ায় লামিয়া বাবার বাড়িতে থাকতেন। তরিকুল প্রায়ই রাতে লামিয়ার বাবার বাড়িতে আসা–যাওয়া করতেন। বিয়ের কয়েক মাস পর তরিকুলের মুঠোফোনে এক মেয়ের পাঠানো খুদে বার্তা নিয়ে মাঝেমধ্যে লামিয়ার ঝগড়া হতো। তরিকুলের মা–বাবা ছেলেকে এক প্রবাসীর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তরিকুলকে বিদেশে নেওয়ার শর্তে ওই প্রবাসীর মেয়েকে বিয়ে করার কথা ছিল। কিন্তু লামিয়া তরিকুলের বাড়িতে গিয়ে বিয়ের দাবিতে অবস্থান করার পর এলাকাবাসী তাঁদের বিয়ে দিয়ে দেন। এতে ক্ষুব্ধ তরিকুলের মা–বাবা লামিয়াকে মেনে নেননি।
সাবিনা বেগম আরও বলেন, বিয়ের চার মাস পর স্থানীয় লোকজন দুই পক্ষের সঙ্গে বসে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সালিস বৈঠকে বসার এক দিন আগে তরিকুল লামিয়াকে ফুসলিয়ে রাতের বেলা ঘর থেকে বের করে নেন। ধারণা করা হচ্ছে, তরিকুল ও তাঁর পরিবার পরিকল্পিতভাবে লামিয়াকে তুলে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করেন। ওই প্রবাসীর মেয়েকে বিয়ে করে বিদেশে যাওয়ার জন্য তরিকুলের পথের কাঁটা হওয়ায় লামিয়াকে হত্যা করা হয়।
লামিয়ার পরিবারের বক্তব্যের সঙ্গে পুলিশ তদন্তে অনেক মিল খুঁজে পেয়েছে। নাজিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, তরিকুল শ্বশুরবাড়িতে তাঁর যাতায়াতের কথা গোপন রাখতে বলতেন লামিয়াকে। এতে লামিয়ার সন্দেহ হলে তাঁকে বাড়িতে তুলে নেওয়ার জন্য তরিকুলকে চাপ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে তরিকুল ও তাঁর পরিবার লামিয়াকে পরিকল্পিতভাবে তুলে নিয়ে হত্যা করে বলে ধারণা করা হচ্ছে। লামিয়াকে অন্য কোথাও হত্যা করে লাশ ওই স্থানে নিয়ে বালিচাপা দেওয়া হতে পারে।
বেনামি চিঠি প্রসঙ্গে (ওসি) মো. হুমায়ুন কবির বলেন, লামিয়ার পরিবারের দাবি চিঠিটি তরিকুলের লেখা। কিন্তু তরিকুল লামিয়ার লাশের সন্ধান দেবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। তরিকুল লাশ গুম করার পর লাশের অবস্থান জানিয়ে চিঠি দেবে, এটা বিপরীতমুখী। হয়তো বিষয়টি জানে, এমন কেউ চিঠিটি লামিয়ার পরিবারের কাছে পাঠাতে পারে।
পুলিশ ও নিখোঁজ ছাত্রীর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, লামিয়া আক্তারের সঙ্গে একই গ্রামের মো. তরিকুল ইসলামের (২২) প্রেমের সম্পর্ক ছিল। গত বছরের ৩০ মে বিয়ের দাবিতে তরিকুল ইসলামের বাড়িতে অবস্থান নেন লামিয়া। এরপর স্থানীয় লোকজনের মধ্যস্থতায় তাঁদের বিয়ে হয়। তবে তরিকুলের মা-বাবা এ বিয়ে মেনে না নেওয়ায় লামিয়া বাবার বাড়িতে চলে আসেন। তরিকুল বিভিন্ন সময়ে লামিয়ার বাবার বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন।
গত বছরের ৬ নভেম্বর রাতে পরিবারের সদস্যদের অগোচরে লামিয়াকে নিয়ে বের হন তরিকুল। এর পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন এই কলেজছাত্রী। তরিকুল ইসলামের বাড়িসহ সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে মেয়ের খোঁজ করেন লামিয়ার বাবা নজরুল ইসলাম। গত ৭ ডিসেম্বর নিখোঁজ লামিয়া আক্তারের মা রাজিয়া বেগম স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর পুলিশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিশ্চিত হন, ঘটনার দিন রাতে তরিকুল ও লামিয়া একসঙ্গে ছিলেন। এরপর ২৫ ডিসেম্বর তরিকুল ইসলামকে প্রধান আসামি করে সাতজনের নাম উল্লেখসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় অপহরণের মামলা করেন রাজিয়া বেগম।
ঘটনার চার মাস পর গত রোববার রাত সাড়ে আটটার দিকে লামিয়ার ঘরের চালে ও বেড়ায় ঢিল ছুড়ে মারা হয়। এতে তাঁর পরিবারের লোকজন ভয় পেয়ে এক আত্মীয়কে ডাকেন। তিনি এসে ঘরে ঢোকার সময় সিঁড়ির ওপর মাটির চাকা দিয়ে চাপা দেওয়া কাগজ পান। ওই কাগজে লেখা ছিল, ‘তোমাদের মেয়ের লাশ মোজাহার মোল্লার বাড়ির পশ্চিম পাশে বালুর মাঠের মধ্যে রাখা আছে।’ ওই চিঠিতে আরও লেখা ছিল, ‘সব জানে মেজ খালা।’ রাতেই লামিয়ার পরিবার পুলিশে খবর দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পাহারা বসায়। গতকাল সকালে বালুর মাঠ খনন করে একটি কঙ্কাল পাওয়া যায়। ওই দিন সন্ধ্যায় পুলিশ লামিয়ার স্বামী তরিকুলের মেজ খালা রেক্সনা বেগমকে গ্রেপ্তার করে।