‘জোবায়ের আমাদের একমাত্র ছেলে ছিল। তাকে নিয়েই আমাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ সব স্বপ্ন। সে একদিন ভালো চাকরি করবে, সংসারের অভাব-অনটন ঘুচবে। আমরা সুখে থাকব। কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আমরা এখন কাকে নিয়ে বাঁচব?’
আজ মঙ্গলবার সকালে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ভরতখালী গ্রামের বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম। গতকাল সোমবার অপরিচিত এক নারীকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রেনের ধাক্কায় তাঁর ছেলে জোবায়ের মিয়া (১৮) নিহত হন।
ওই নারী শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। জোবায়ের বাঁচাতে গেলে তিনজনই ট্রেনের ধাক্কা খান। এতে শিশুসন্তান বেঁচে গেলেও ওই নারী ও জোবায়েরের মৃত্যু হয়।
নিহত জোবায়ের ফুলছড়ির একটি মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন। এরপর সদর উপজেলার উত্তর হরিণসিংহা এলাকার এসকেএস স্কুল অ্যান্ড কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করে একই কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়েছিলেন।
স্বজনেরা জানান, জোবায়ের শহরের থানাপাড়ার একটি মেসে থেকে লেখাপড়া করতেন। গতকাল রেললাইনের পাশ দিয়ে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় ওই নারীকে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে দেখে তিনি বাঁচাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে ভরতখালী গ্রাম। গতকাল রাতে পারিবারিক কবরস্থানে জোবায়েরের দাফন সম্পন্ন হয়। আজ সকালে ভরতখালী গ্রামে গিয়ে এলাকাবাসীকে মাতম করতে দেখা যায়। বাড়ির আঙিনায় নির্বাক বসে আছেন জোবায়েরের মা, বাবা ও বোন। স্বজনেরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ছেলের প্রসঙ্গ উঠতেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
মা জেবা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘রোজার কয়েক দিন আগে বাড়ি থেকে গেছে। এর পর থেকে সে মেসে ছিল। আগামী বৃহস্পতিবার ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসার কথা। বাড়ি আসার পর সে ঈদের কেনাকাটা করতে চেয়েছিল। তার সেই আশা আর পূরণ হলো না। আমরা কাকে নিয়ে ঈদ করব? কত স্বপ্ন ছিল, সব শেষ হয়ে গেল।’
জোবায়েরের বাবা জাহিদুল পেশায় একজন দরজি। দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে জোবায়ের ছোট। বড় মেয়ে জান্নাতি খাতুনের বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়ের বিয়ের পর জোবায়েরই ছিল সব। আগে বাড়ি ছিল ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নে। নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে ছয় বছর আগে ভরতখালী গ্রামে এসে পাঁচ শতক জমি কিনে বসবাস শুরু করেন। বসতভিটা ছাড়া কোনো সম্পদ নেই। দরজির কাজ করে কোনোমতে সংসার চলে। তা দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন। জোবায়েরের এক মামাও তাঁকে সহায়তা করতেন।
এসকেএস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক কে এম রায়হানুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জোবায়ের খুব ভালো ছাত্র ছিল। কলেজ থেকে তার বেতন–ভাতা নেওয়া হতো না। সে প্রথম আলোর জিপিএ-৫ সংবর্ধনাও পেয়েছে। তিনি বলেন, জোবায়ের অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়েছে। ঘটনাটি বেদনাদায়ক হলেও জোবায়ের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
ট্রেনের ধাক্কায় মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়া শিশু আবির হোসেন বর্তমানে শঙ্কামুক্ত। গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সে বাড়ি ফিরেছে। বর্তমানে বাবার বাড়িতে আছে। পরিবারের লোকজন তার দেখভাল করছেন। গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) এ এস এম রুহুল আমিন বলেন, দেড় বছর বয়সী আবিরের মাথায় ও পেটে আঘাত লেগেছে। চিকিৎসা দেওয়ার পর এখন সে শঙ্কামুক্ত।
গতকাল দুপুরে পারিবারিক কলহের জেরে গৃহবধূ রাজিয়া বেগম শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন রেললাইনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন জোবায়ের। তিনি তাঁদের ঝাঁপ দিতে দেখে রেললাইন থেকে ধাক্কা দেন। তখন সান্তাহারগামী লোকাল ট্রেনের ধাক্কায় তিনজনই রেললাইন থেকে ছিটকে পড়েন। এতে রাজিয়া ও জোবায়ের নিহত হন।
নিহত রাজিয়া গাইবান্ধা শহরের মাঝিপাড়া এলাকার দিনমজুর আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী। রাজিয়ার বাড়ি সুনামগঞ্জে। চার বছর আগে মুঠোফোনে প্রেমের সম্পর্কের পর আনোয়ারের সঙ্গে রাজিয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে তাঁরা শহরের মাঝিপাড়া এলাকায় বসবাস করতেন। সম্প্রতি পারিবারিক কলহের জেরে গৃহবধূ রাজিয়া দেড় বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিতে যান।
ঘটনার পর শহরের মাঝিপাড়ার বাড়িতে গিয়ে ও মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও গৃহবধূর স্বামী আনোয়ার হোসেনকে পাওয়া যায়নি। তবে এলাকাবাসী জানিয়েছেন, আনোয়ার এলাকাতেই আছেন। সদর থানার উপপরিদর্শক আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর গৃহবধূর লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাজিয়ার স্বজনেরা তাঁর লাশ সুনামগঞ্জে নিয়ে গেছেন।