বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাহাড়ে গোলাগুলি চলছেই। আজ শনিবার সকাল ৯টার পর থেকে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে সীমান্তের এপারে। বেলা ২টা পর্যন্ত থেমে থেমে ছোড়া হচ্ছে আর্টিলারি ও মর্টার শেল। গোলাগুলির মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এপারের জনবসতিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি ভারী অস্ত্রের গুলি এপারের ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু বাজারের পাশে কৃষক শাহজাহানের বাড়ির আঙিনায় এসে পড়ে। বাড়িটির পাশেই শূন্যরেখায় চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গার আশ্রয়শিবির।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু প্রথম আলোকে বলেন, শাহজাহানের আঙিনায় এসে পড়া তাজা গুলিটি উদ্ধার করেছে বিজিবি। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সীমান্তে বিজিবি তৎপর আছে।
আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা, ঘুমধুমের জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, গতকাল বিকেল তিনটার পর হঠাৎ রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং ও খ্য মং সেক পাহাড়ে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) গোলাগুলি শুরু হয়। চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। মিয়ানমারের পাহাড় থেকে ছোড়া একে-৪৭, এম-১৬ ও জি-থ্রি রাইফেলের গুলি এসে পড়ছে নো ম্যানস ল্যান্ডের ধান চাষের জমিতে। একটি গুলি এসে পড়েছে কৃষক শাহজাহানের বাড়িতে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, আজ সকাল ৯টার পর থেকে থেমে থেমে দুই পক্ষের গোলাগুলি চলছে। আর্টিলারি, মর্টার শেল ও গোলার বিকট শব্দে তুমব্রু সীমান্ত কাঁপছে। শূন্যরেখার আশপাশে প্রায় ৮০০ একর জমিতে বাংলাদেশি কৃষকের জুম, ধান ও শাকসবজির চাষাবাদ করেন। সীমান্তে ব্যাপক গোলাগুলি ও বাংলাদেশ অংশে গুলি এসে পড়ায় চাষিরা আতঙ্কে খেত-খামারে যেতে সাহস করছেন না।
নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আবছার বলেন, তাঁর ইউনিয়নের চাকঢালা, জামছড়ি, আশারতলী, আমতলী এলাকা পড়েছে মিয়ানমার সীমান্তে। সেখানে স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বাঙালিরা জুম, ধান, শাকসবজির চাষাবাদ করেন। ওপারের গোলাগুলিতে তাঁরা আতঙ্কে আছেন।
চাকঢালার কৃষক আলো মং মারমা জানান, গোলাগুলির শব্দ এবং গুলি এসে পড়ার শঙ্কায় বহু কৃষক জুমচাষে যেতে পারছেন না। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জুমচাষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা আছে।
তুমব্রু এলাকার চাষি আবুল কালাম বলেন, শূন্যরেখার পাশে তাঁর ধান চাষের জমি আছে। চারা রোপণ হয়েছে কয়েক সপ্তাহ আগে। এখন সার দিতে হবে। কিন্তু মাঠে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। মাঠের পাশের পাহাড় থেকে গুলি ছোড়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখার ৩৯, ৪০ ও ৪১ নম্বর পিলারের কাছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে স্থানীয় লোকজনের ২০টির বেশি রবারবাগান আছে। এতে শ্রমিক আছেন তিন হাজারের বেশি। ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া মর্টার শেল রবারবাগানের পাশে এসে পড়ায় বাগানের দুই হাজার শ্রমিককে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনা হয়েছিল। চার দিন আগে শ্রমিকেরা কাজে ফিরে গেলেও এখন তাঁরা গুলি আতঙ্কে ভুগছেন।
রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং পাহাড়ের পাদদেশে শূন্যরেখায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবির। সেখানে পাঁচ বছর ধরে বাস করছেন ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি) শিবিরের রোহিঙ্গাদের খাবার ও ত্রাণসহায়তা দিয়ে আসছে।
শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল এসে পড়েছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ঘুমধুমে। গতকাল বিকেলে তুমব্রুর যে বাড়িতে গুলি এসে পড়েছে, সেটি আশ্রয়শিবিরের একেবারেই কাছে। মিয়ানমারের পাহাড় থেকে ছোড়া অধিকাংশ গুলি আশ্রয়শিবিরের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কিংবা খামখেয়ালিপনায় কোনো মর্টার শেল, বোমা কিংবা গুলি আশ্রয়শিবিরে এসে পড়লে হতাহতের শঙ্কা আছে। কারণ এখানে ঘনবসতি।
আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা বলেন, শিবিরের পেছনে লাগোয়া পাহাড়ের চূড়ায় মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর একাধিক চৌকি স্থাপন করা হয়েছে। সকাল থেকে সেখানে অস্ত্রধারী লোকজনকে দাঁড়িয়ে এবং পাহাড়ের নিচের জঙ্গলে টহল দিতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের তুমব্রু বাজার থেকেও খালি চোখে পাহাড়ের চৌকি দেখা যায়। চৌকি থেকেই থেমে থেমে আর্টিলারি ও মর্টার শেল ছোড়ার শব্দ কানে আসছে।
সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা একাধিক সূত্র এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কখন গুলি শুরু হয়, কখন বন্ধ হয়—তার হিসাব নেই। কিন্তু বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মর্টার শেল কিংবা গুলি এসে পড়লে সমস্যা এবং শঙ্কা দেখা দেয়। এর আগেও দুই বার (২৮ আগস্ট ও ৩ সেপ্টেম্বর) হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া দুটি মর্টার শেল এসে পড়ার ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল বাংলাদেশ।