গ্রামের নিরিবিলি পরিবেশে বৃদ্ধাশ্রমটিতে আছেন ৩১ জন বাসিন্দা। রংপুর নগরের বকসা এলাকায়
গ্রামের নিরিবিলি পরিবেশে বৃদ্ধাশ্রমটিতে আছেন ৩১ জন বাসিন্দা। রংপুর নগরের বকসা এলাকায়

ঈদে সন্তানদের কথা মনে করে ‘কষ্টে বুক ফাটে’ বৃদ্ধাশ্রমের জমিলা, রইসদের

রংপুর নগরের জুম্মাপাড়ার বাসিন্দা জমিলা খাতুন। বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে। স্বামী নেই। দুই ছেলের একজন বিদেশে থাকেন। এক ছেলে চাকরি করলেও খোঁজ নেই। ১৫ দিন হলো তাঁর আশ্রয় হয়েছে নগরের বকসা গ্রামের বৃদ্ধাশ্রমে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আইজকা শেষ রোজা। কালকে ঈদ। এই ঈদোত মানুষজন ছাওয়া-পোওয়া (সন্তান) নিয়া ঈদের আনন্দ করবে। আর আমাকে এই জায়গাত (বৃদ্ধাশ্রম) কে যে রাখি গেল, তাও বলতে পারি না। ছেলের সঙ্গে এবার ঈদের আনন্দ করবার পারলাম না। কষ্টে বুকটা ধড়ফড় করে।’

শুধু জমিলা নন, সন্তানদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ উদ্‌যাপন করতে না পারার একই রকম দুঃখ–কষ্টের কথা জানালেন বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা লাভলী বেগম, রইস উদ্দিন, সালেহা বেগম, সাজেদা বেগম, সাকিলা বেগমসহ আরও অনেকে। রংপুর মহানগরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বকসা এলাকায় ‘বকসা বৃদ্ধাশ্রম’। ৩১ শতাংশ জমির ওপর গ্রামের নিরিবিলি পরিবেশে বৃদ্ধাশ্রমটিতে ১৫ জন নারী ও ১৬ জন পুরুষ বসবাস করেন। ঢাকা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় তাঁদের আদিনিবাস হলেও এখন আশ্রয় হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে।

আধা পাকা টিনশেডের বাড়িতে সরেজমিনে দেখা যায়, কয়েকটি কক্ষ। কোনো কক্ষে দুটি, আবার কোনো কক্ষে তিনটি, চারটি বিছানাও রয়েছে। মাথার ওপর ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। কেউ শুয়ে আছেন, কেউ–বা বসে, আবার কেউ কেউ হাঁটাচলা করছেন। নতুন মানুষ এলে তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলেন।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন রইস উদ্দিন। বয়স ৭৫ পেরিয়ে গেছে। বাড়ি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায়। স্ত্রী নেই। দুই ছেলে ও চার মেয়ে। সবারই বিয়ে দিয়েছেন। কষ্ট কী জিনিস, তা কখনো উপলব্ধি করেননি। জমিজমার অভাবও ছিল না তাঁর। মাঠভরা ফসলের সমারোহেও তাঁর জীবনযাপন ছিল সাদামাটা। তবে তিনি ছিলেন বেশ শৌখিন। সন্তানদের জন্য অনেক করেছেন। ছেলেকে বাড়ি করে দিয়েছেন, আবার বিদেশেও পাঠিয়েছিলেন। আট মাস হলো তাঁর ঠাঁই হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমে।

ছলছল চোখে রইস উদ্দিন বলেন, ‘সন্তানদের কথা মনে হলে কলিজা ধড়ফড় করে, বুকটা ফারি যায়। কালকে ঈদ। ছাওয়ারা আনন্দ করবে। তারপরও অ্যাটে খুব ভালো আছি। বৃদ্ধাশ্রমে সেমাই খামো, পোলাও গোশত খামো।’ তিনি আরও বলেন, সন্তানেরা পাশে না থাকলেও এখানে ভালো আছেন। এখানে দেখাশোনা ও সেবাযত্ন করার মানুষ আছে। এর চেয়ে এখন আর বেশি কিছু আশা করেন না।

বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের নিয়মিত তিন বেলা খাবার দেওয়া ছাড়াও অসুস্থদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে

বৃদ্ধাশ্রমে ঘুরতে ঘুরতে দেখা গেল, এক বৃদ্ধকে নলকূপে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী শহিদুল ইসলাম। বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের দেখাশোনার জন্য তাঁর মতো তিনজন কর্মচারী আছেন। শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘একেকজনের জীবনের গল্পটা একেক রকম। আমি তাঁদের খাওয়া, গোসল করানো ও ওষুধ খাওয়ানো থেকে সব কাজ করে দিই। যখন তাঁদের কষ্টের কথাগুলো শুনি, তখন আমি আর নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। এসব মা-বাবাকে দেখে আমার খুব কষ্ট হয়।’

বৃদ্ধাশ্রমে রংপুর নগরীর মিস্ত্রিপাড়া থেকে এসেছেন সালেহা বেগম। তাঁর স্বামী মারা গেছেন অনেক বছর হলো। কষ্টের সংসার। দুই ছেলে রিকশা চালিয়ে নিজেদের সংসার সামলাতে পারলেও মাকে ধরে রাখতে পারেননি কেউই। তিনি বলেন, ‘এই মায়ের কথা কোনো ছেলেই মনে রাখল না। আমি তাদের জন্য কত কষ্ট করেছি। আজ আমার তাদের কাছে জায়গা হয় না। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি ওরা যেন সুখে থাকে।’
রাজধানী ঢাকার নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা সাকিলা বেগমও থাকেন বকশার এই বৃদ্ধাশ্রমে। তাঁর বয়স আশির কাছাকাছি। স্বামী বেঁচে নেই। একটিমাত্র ছেলে। সেখানে মাথা গোঁজার জায়গা হয়নি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সাকিলা বেগম বলেন, ‘ছেলে থেকে লাভ কী? আমাকে বাড়ি থেকে বের করে একটা বাসে তুলে দিয়েছিল। আমি দিনাজপুরে চলে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আমাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে আনা হয়েছে।’

বকসা বৃদ্ধাশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা রেজাউল করিম। তিনি রিজার্ভ অফিসার হিসেবে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত রয়েছেন। এসআই রেজাউল করিম দুই বছর আগে তাঁর পৈতৃক ভিটা রংপুর মহানগরীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ময়নাকুঠি বকসা এলাকার বিঘাখানেক জমিতে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন এই ‘বকসা বৃদ্ধাশ্রম’। নিজের বেতনের টাকা ছাড়াও পরিবারের সহযোগিতা রয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনায়। সেখানে থাকা বৃদ্ধ বাবা–মায়েদের থাকা–খাওয়া, কর্মচারীর বেতন, অ্যাম্বুলেন্স খরচ, চিকিৎসা খরচ, ওষুধ, কাপড়সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে মাসে লাখ দেড়েক টাকা খরচ হয়ে থাকে। স্থানীয়দের অনেকেই মা–বাবার মৃত্যুবার্ষিকী, ছেলেমেয়ের জন্মদিনসহ বিভিন্ন উপলক্ষ ঘিরে এই বৃদ্ধাশ্রমে কখনো কখনো একবেলা খাবারের ব্যবস্থা করে থাকেন।

বৃদ্ধাশ্রমে আসা মানুষদের সেবাযত্নে রেজাউল করিমের সবচেয়ে বড় নির্ভরতা তাঁর স্ত্রী নাহিদ নুসরাত। আর মা–বাবার পাশে ছায়ার মতো সঙ্গী হয়েছেন মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমে ৩১ জন আছেন। কারও কারও পরিবার থেকে এখানে রেখে গেছে। তবে পরিবার থেকে আসা বাবা–মায়েদের খোঁজখবর কেউ রাখেন না। আমি সব সময় চেষ্টা করি সবাইকে হাসিখুশি রাখার। কারও কোনো আবদার থাকলে সেটা পূরণ করারও চেষ্টা করি।’ তিনি জানান, বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের নিয়মিত তিন বেলা খাবার দেওয়া ছাড়াও অসুস্থদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। যদি কেউ অসুস্থ হন, তাঁদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স সুবিধাও রয়েছে।

এসআই রেজাউল করিম বর্তমানে বৃদ্ধাশ্রমের অবকাঠামোগত উন্নয়নের চেষ্টা করছেন। কিন্তু অর্থাভাবে পারছেন না উল্লেখ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি অবকাঠামোগত দিক থেকে উন্নত করা যেত, তাহলে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে এসব মা-বাবা আরও ভালো থাকতে পারবেন। এখন তাঁদের সপ্তাহে এক দিন একজন চিকিৎসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। আমি চাই প্রত্যেক মা-বাবা ভালো থাকুন। সবার সহযোগিতা পেলে হয়তো বৃদ্ধাশ্রমটিকে আরও সুন্দর পরিবেশে উন্নত করা সম্ভব হবে।’