দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রচার–প্রচারণার শুরুর পর থেকে প্রতিদিন সংঘাত–সংঘর্ষ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী–সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছিল। এবার খোদ দুই প্রার্থী অভিযোগ করলেন, তাঁদের প্রচারকাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একজনকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়েছে। অপরজনের ওপর হামলা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গায় স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতা দিলীপ কুমার আগরওয়ালার অভিযোগ, শনিবার রাতে প্রচার চালানোর সময় নৌকা প্রতীকের কর্মী–সমর্থকেরা তাঁর পথ অবরুদ্ধ করে দুই ঘণ্টা আটকে রাখেন। মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাঁকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে নৌকা প্রতীকের পাঁচ কর্মী–সমর্থককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় বগুড়ায় বাংলাদেশ কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের ওপর নৌকা প্রতীকের কর্মী–সমর্থকেরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত শনিবার রাত থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত ছয়টি আসনের ছয়টি স্থানে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অন্তত নয়জন আহত হয়েছেন। নির্বাচনের প্রচার শুরু হয় ১৮ ডিসেম্বর। সেদিন থেকে গতকাল পর্যন্ত সাত দিনে ৫২টি স্থানে সংঘাতের ঘটনা ঘটল।
চুয়াডাঙ্গা-১ (আলমডাঙ্গা ও সদরের একাংশ) আসনে নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য দিলীপ কুমার আগরওয়ালার গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। স্বতন্ত্র এই প্রার্থীর অভিযোগ, গত শনিবার রাত পৌনে নয়টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদরের ভান্ডারদহ এলাকায় পৌঁছালে অর্ধশতাধিক যুবক তিনিসহ তাঁর কর্মীদের তিনটি গাড়ি আটকে দেন। এ সময় তাঁরা নৌকা প্রতীকের স্লোগান দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি গাড়ি থেকে নামলে তাঁর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাঁকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়। এভাবে দুই ঘণ্টার বেশি সময় অবরুদ্ধ থাকার পর জেলা প্রশাসক কিসিঞ্জার চাকমা ও পুলিশ সুপার আর এম ফয়জুর রহমানের সহায়তায় রাত ১১টার দিকে তিনি উদ্ধার পান।
স্বতন্ত্র প্রার্থী দিলীপ কুমার আগারওয়ালা ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল, একজন প্রার্থী হিসেবে সম্মান পাব, কিন্তু তারা তা করেনি।’
এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা–১ আসনের নৌকার প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার আজ সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর বক্তব্য জানাবেন।
রাতের ঘটনায় দিলীপ কুমারের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী মো. আবদুল মালেক গতকাল ভোরে সদর থানায় মামলা করেছেন। পরে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলী আহাম্মেদ হাসানুজ্জামানসহ নৌকা প্রতীকের পাঁচ কর্মী-সমর্থককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গতকাল তাঁদের আদালতে হাজির করা হলে হাসানুজ্জামানকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত।
রিটার্নিং কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক কিসিঞ্জার চাকমা শনিবার রাতের ঘটনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রকার সহিংস ঘটনাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। অপরাধ যে–ই করুক, তাকে শাস্তি পেতে হবে। ভোটাররা যাতে নির্ভয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন, সে জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে বাংলাদেশ কংগ্রেস মনোনীত প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের (ডাব প্রতীক) নির্বাচনী প্রচারণায় আবারও হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল সন্ধ্যায় কাহালু বাজারে এ হামলার ঘটনা ঘটে। নৌকা প্রতীকের কর্মী-সমর্থকেরা এ হামলা করেছেন বলে হিরো আলম অভিযোগ করেছেন।
তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন করে হিরো আলম অভিযোগ করেন, সন্ধ্যায় ১৪-১৫ জন কর্মী-সমর্থক নিয়ে তিনি কাহালু বাজারে গণসংযোগ চালাতে যান। এ সময় রমজান আলী নামের একজনের নেতৃত্বে নৌকার সমর্থকেরা তাঁর প্রচারণায় বাধা দেন। এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা হলে নৌকার সমর্থকেরা তাঁর ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালান। হামলাকারীরা আওয়ামী লীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মী।
এ ব্যাপারে কাহালু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হেলাল উদ্দিন কবিরাজ বলেন, রমজান আলী আওয়ামী লীগের কেউ নন। জাসদের লোক হতে পারেন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ থেকে জাসদের প্রার্থী রেজাউল করিমকে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ নিজেদের মতো করে নৌকার প্রচারণা চালাচ্ছে। জাসদের কেউ আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ওপর হামলা করলে কিংবা প্রচারণায় বাধা দিলে তার দায় দল নেবে না।
এর আগে শনিবার নন্দীগ্রাম উপজেলার মুরাদপুর বাজারে নির্বাচনী প্রচারণে নৌকার সমর্থকদের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করেন হিরো আলম।
জানতে চাইলে নন্দীগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈকত হাসান বলেন, ‘হিরো আলমের ওপর হামলার লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি।’
মেহেরপুর-১ (সদর-মুজিবনগর) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী, সাবেক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান ফোন করে সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর একটি রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ওই কর্মকর্তা এ ঘটনায় কোথাও লিখিত অভিযোগ দেননি।
মেহেরপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। আর সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার নাম অলোক কুমার দাশ।
১ মিনিট ২ সেকেন্ডের অডিওতে আবদুল মান্নান তাঁকে বলেন, ‘তুমি অলোক কুমার দাশ, বাইরে থেকে এসে বাড়িঘর তৈরি করে খুব আরামেই আছ। পয়সা অনেক কামাই করেছ। আমি কিন্তু যেমন ভালো লোক, তেমন খারাপ লোক। তোমাকে প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন প্রমোশন দেয়নি। বাংলাদেশ সরকার তোমার প্রমোশন করে দিয়েছে। মন্ত্রীকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে আর একটা কথা শুনি, তাহলে আমি এমপি হই আর না হই, তোমার মেহেরপুরের বাসা আমি উঠিয়ে দেব। আর তুমি যদি সাবধান হয়ে যাও, তাহলে আমার স্নেহ তোমার ওপর থাকবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে যোগ দেওয়ায় উপজেলার কুন্ডা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে জনসভায় হুমকি দিয়েছেন নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য। হুমকির ওই ভিডিও ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগে সম্প্রতি একজন সাংবাদিককে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে আবদুল মান্নান বলেন, উনি সরকারি কর্মকর্তা হয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁকে বিষয়টি বোঝাতে তিনি ফোন করেছিলেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য বি এম ফরহাদ হোসেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী। এই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান। এই আসনে আওয়ামী লীগের তিনজন মনোনয়নপ্রত্যাশীসহ উপজেলা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাবেক একাধিক নেতা-কর্মী এবং বর্তমান ও সাবেক একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান একরামুজ্জামানকে সমর্থন দিয়ে তাঁর পক্ষে কাজ করছেন। ফরহাদ, একরামুজ্জামানসহ এখানে পাঁচজন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
গত শুক্রবার বিকেলে উপজেলার কুন্ডা ইউনিয়নের কুন্ডা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন। সেখানে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন ভূঁইয়ার উদ্দেশে সংসদ সদস্য বলেন, ‘এই নাসিরনগর থেকে তোমার নাম মুছে যাবে।’
ফরহাদ হোসেন আরও বলেন, ‘তুমি নৌকায় উঠে নৌকার পিঠে ছুরিকাঘাত করার চেষ্টা করবা, তুমি বোকার স্বর্গে বসবাস করছ, নাসির। এটা তোমাকে পরিষ্কার বলে দিলাম। আমি তোমার মতো শিক্ষিত ছেলের কাছে এটা আশা করি না, আশা করি নাই, আশা করি নাই।’
সংসদ সদস্যের বক্তব্যের বিষয়ে কুন্ডা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকাশ্যে জনসভায় নাসিরনগর থেকে আমার নাম মুছে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এতে আমি নিরাপত্তাহীনতায় আছি।’
চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে আওয়ামী লীগ ও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত থামছেই না। গত এক সপ্তাহে পাঁচ দফা হামলার ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন উভয় পক্ষের অন্তত আটজন। সর্বশেষ গতকাল রাত নয়টায় উপজেলার সন্তোষপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রচারণা শেষে ফেরার পথে কর্মীদের ওপর হামলা হয়। এতে দুজন আহত হয়েছেন।
মানিকগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের সমর্থকদের বিরুদ্ধে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহিদ আহম্মেদ ওরফে টুলুর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর তিনজন সমর্থক আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। গতকাল বিকেলে হরিরামপুর উপজেলা সদরে এ ঘটনা ঘটে। হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নৌকার সমর্থক জেলা আওয়ামী লীগের নেতা আবিদ হাসান।
রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিশ্বনাথ সরকার ওরফে বিটুর নির্বাচনী কর্মীদের মারধর করে ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়া হয়েছে। গত শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বদরগঞ্জ পৌরবাজারে স্থানীয় সংসদ সদস্য নৌকার প্রার্থী আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ওরফে ডিউক চৌধুরীর সমর্থকেরা ওই হামলা চালান বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে আহসানুল হক চৌধুরীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে অভিযুক্ত নৌকার সমর্থক মাহবুব হাসান বলেন, ‘আমি কাউকে মারধর করিনি। এসব মিথ্যা অভিযোগ।’
তবে ময়মনসিংহের নান্দাইলে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। নৌকার কর্মীদের ওপর স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাচনী ক্যাম্প বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আনোয়ারুল আবেদীন খানের সমর্থকদের মারধরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব.) আবদুস সালামের চারজন কর্মী আহত হয়েছেন। গত শনিবার রাত একটার দিকে উপজেলার আচারগাঁও ইউনিয়নের পুরহারি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।