সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের (ফাঁদ) মাধ্যমে বাঘ গণনা কার্যক্রম চলছে। গত ৩০ এপ্রিল পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। গণনার কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ওই দুই রেঞ্জে বাঘের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে, খুলনা রেঞ্জে ২০১৫ ও ২০১৮ সালে করা জরিপে বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বললেই চলে। সেই তুলনায় এবার খুলনা রেঞ্জে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কিছু কিছু স্থানে বড় বাঘের সঙ্গে বাচ্চার ছবিও ক্যামেরায় ধরা পড়েছে বলে দাবি করছেন তাঁরা।
আগামী ১ নভেম্বর থেকে পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজ শুরু হবে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি বাঘ গণনায় ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজের উদ্বোধন করা হয়।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ও ‘সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’–এর পরিচালক আবু নাসের মোহসিন হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ক্যামেরা ট্র্যাপিং থেকে পাওয়া তথ্য এখনো পর্যালোচনা করা হয়নি। এ কারণে ওই দুই রেঞ্জে কত বাঘের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কিছুদিনের মধ্যেই ডাটা সেন্টারে নিয়ে ক্যামেরায় পাওয়া বাঘের ছবিগুলো পৃথক করে পর্যবেক্ষণ করা হবে। এরপর পূর্ব বন বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে ২০২৪ সালে বাঘ গণনার তথ্য প্রকাশ করা হবে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় বাঘ গণনা করা হচ্ছে। গত বছরের ২৩ মার্চ প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এর আওতায় একই সঙ্গে সুন্দরবনের বাঘ স্থানান্তর, অন্তত দুটি বাঘের শরীরে স্যাটেলাইট কলার স্থাপন ও মনিটরিং করা, বাঘের পরজীবীর সংক্রমণ ও অন্যান্য ব্যাধি এবং এর মাত্রা নির্ণয়, উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হবে। এর বাইরে সুন্দরবন সুরক্ষারও কাজ রয়েছে ওই প্রকল্পে।
বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে আগে যেসব জায়গায় বাঘের উপস্থিতি ছিল না, এখন সেসব জায়গায় বাঘের আনাগোনা পাওয়া গেছে। সার্বিকভাবে মনে হচ্ছে, আগের তুলনায় বাঘের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বনদস্যু না থাকায় এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। বনে বাঘের সংখ্যা বেশি থাকার মানে হলো সুন্দরবনের ভালো থাকা।
সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, মানুষের আঙুলের ছাপের মতোই বাঘের গায়ের ডোরাকাটা দাগও একেক বাঘের একেক রকম। মূলত ক্যামেরায় ধরা পড়া বাঘের ছাপগুলো আলাদা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ ও গবেষণাপদ্ধতি প্রয়োগ করে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর আওতায় সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণ ও সুরক্ষার কাজও করা হবে। এর মধ্যে ৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা খরচ করা হবে বাঘ গণনায়। প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত। তবে ২০২৪ সালে বাঘ গণনার কার্যক্রম শেষ করা হবে। এরপর শুরু হবে অন্যান্য কাজ।
জানা গেছে, আগামী ১ নভেম্বর থেকে বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জ এলাকা দিয়ে আবার শুরু হবে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজ। ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি টানা চার মাসের এই কাজ চাঁদপাই রেঞ্জ দিয়ে শেষ হবে। সুন্দরবনের মোট ৬৬৫টি গ্রিডে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের কাজ করা হবে। ইতিমধ্যে সাতক্ষীরা রেঞ্জে ২০০টি ও খুলনা রেঞ্জে ১৪০টি স্থানে ক্যামেরা বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ছয় মাস ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম হওয়ায় ক্যামেরা বসানোর কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। শরণখোলায় ১৮০ এবং চাঁদপাইতে ১৪৫টি ক্যামেরা বসানো হবে। ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে শুধু বাঘ নয়, বাঘের খাদ্য হিসেবে সুন্দরবনে অন্যান্য প্রাণী (হরিণ ও শূকর) কেমন আছে, সেটিও জরিপ করা হচ্ছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বনভূমি ৪ হাজার ৮৩২ এবং জলাভূমি ১ হাজার ১৮৫ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই বনভূমির স্থলে ২৮৯ প্রজাতির প্রাণীর বসবাস। এ ছাড়া ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী বাস করে। ২০১৫ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘ ছিল ১০৬টি। আর ২০১৮ সালের শুমারিতে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪।