কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত বরিশাল বিএনপি

বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপির কার্যালয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নগরের সদর রোডে
ছবি: প্রথম আলো

কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে বরিশালে বিএনপির রাজনীতি। দ্বন্দ্বের জেরে দলটির কর্মসূচিতে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে মারামারি, নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল ও টাকার বিনিময়ে নেতা বানানোর মতো অভিযোগ উঠছে। কেউ কেউ দলীয় কার্যালয়ে তালাও ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। বিএনপির চলমান আন্দোলন-সংগ্রামে বরিশালে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা বিএনপির এক নেতা অসহায়ত্ব প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থাকব, নাকি কোন্দল মেটাব—কিছুই বুঝতে পারছি না। দল ক্ষমতায় নেই তাতেই একে অপরের সঙ্গে হানাহানিতে লিপ্ত হচ্ছে। ক্ষমতায় গেলে না জানি কী হয়!’

যেখানেই কমিটি দিই, সেখানেই একটি পক্ষ মিছিল, মিটিং করে ঝড় তুলছে। এমনকি নেতাদের বিরুদ্ধে টাকাপয়সা লেনদেনের অভিযোগ তুলছে। জেলার নেতাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছে। এটা কী ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বুঝতে পারছি না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা বিএনপির এক নেতা

ওই নেতা আরও বলেন, ‘যেখানেই কমিটি দিই, সেখানেই একটি পক্ষ মিছিল, মিটিং করে ঝড় তুলছে। এমনকি নেতাদের বিরুদ্ধে টাকাপয়সা লেনদেনের অভিযোগ তুলছে। জেলার নেতাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছে। এটা কী ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বুঝতে পারছি না।’

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বরিশালে বিএনপির প্রায় সব উপজেলা কোন্দলে জর্জরিত। এর মধ্যে বরিশাল সদর, হিজলা, গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, বাকেরগঞ্জ, গৌরনদী পৌর কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমে। গত সোমবার গৌরনদী উপজেলা ও পৌর কমিটি এবং আগৈলঝাড়া উপজেলার নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন পদবঞ্চিত নেতারা।

নগরের সদর রোডে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সমাবেশে উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য আফজাল হোসেন সিকদারের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন আবুল হোসেন, মঞ্জুর হোসেন, শরীফ স্বপন, কাজী সরোয়ারসহ স্থানীয় নেতারা। বক্তারা উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক দেওয়ান মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহ ও সদস্যসচিব মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ওই দুই উপজেলা ও পৌর কমিটি গঠনে টাকা লেনদেনের অভিযোগ করেন। তাঁরা ওই কমিটি প্রত্যাহার ও উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি ঘোষণার দাবি জানান।

উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য এস এম আফজাল অভিযোগ করেন, ওই কমিটিগুলোতে যাঁরা স্থান পেয়েছেন, তাঁরা ১/১১-এর সংস্কারপন্থী, জাতীয় পার্টি থেকে আসা নেতা ও ব্যবসায়ী। গৌরনদী উপজেলা কমিটিতে দুজন প্রবাসীও আছেন। অন্যদিকে যাঁরা ত্যাগী, মামলা-হামলার শিকার, তাঁদের কমিটিতে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিতর্কিত ওই বাতিলের দাবি জানান তিনি।

ওই কমিটিগুলোতে যাঁরা স্থান পেয়েছেন, তাঁরা ১/১১-এর সংস্কারপন্থী, জাতীয় পার্টি থেকে আসা নেতা ও ব্যবসায়ী। একটি কমিটিতে দুজন প্রবাসীও আছেন। অন্যদিকে যাঁরা ত্যাগী, মামলা-হামলার শিকার, তাঁদের কমিটিতে উপেক্ষা করা হয়েছে।
এস এম আফজাল, সদস্য, উত্তর জেলা বিএনপি

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৮ জানুয়ারি কবির তালুকদারকে আহ্বায়ক ও বশির আহমেদকে সদস্যসচিব করে আগৈলঝাড়া; সরোয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক ও জহির সাজ্জাদ হান্নানকে সদস্যসচিব করে গৌরনদী উপজেলা এবং জাকির শরীফকে আহ্বায়ক ও ফরিদ মিয়াকে সদস্যসচিব করে গৌরনদী পৌর কমিটি করা হয়। গৌরনদী ও আগৈলঝাড়াতে সাবেক সংসদ সদস্য দলের মিডিয়া সেলের প্রধান জহির উদ্দিনের (স্বপন) অনুসারীরা বেশি পদ পেয়েছেন। এতে ক্ষুব্ধ হন সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবাহান ও কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানের অনুসারীরা।

১৪ ফেব্রুয়ারি মুলাদী উপজেলা ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করেন আগের কমিটির নেতা-কর্মীরা। ওই বিক্ষোভ মিছিলে হামলা করে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। এ সময় উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবদুস ছত্তার খানের বাড়িতে হামলা হয়। তিনি মুলাদী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।

আবদুস ছত্তার খান বলেন, সম্প্রতি মুলাদী উপজেলা ও পৌর বিএনপির যে কমিটি দেওয়া হয়, তাতে সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতা আছে। সে জন্য বঞ্চিত নেতা-কর্মীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা হামলা করেন।

দলীয় সূত্র জানায়, ১০ জানুয়ারি মুলাদী উপজেলা ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব পৃথক দুটি কমিটি ঘোষণা করেন। ওই কমিটি ঘোষণার পরপরই স্থানীয় নেতা-কর্মীরা তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং বিক্ষোভ করেন।

অভিযোগের বিষয়ে উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক দেওয়ান মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ওই এলাকায় বিএনপির চারজন কেন্দ্রীয় নেতা আছেন। তাঁদের সমর্থকেরা এসব করছেন। কার লোক কমিটিতে বেশি স্থান পেল, কারা পেল না, এ নিয়ে দ্বন্দ্ব। তিনি তাঁদের বলেছেন, ‘আপনারা বসে কমিটি দেন।’ কিন্তু তাঁরা দিতে পারেননি। কমিটি করার ব্যাপারে তাঁর বাধ্যবাধকতা থাকায় তিনি কমিটি দিয়েছেন। এখন বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে। এভাবে দল চলবে কীভাবে? অভিযোগগুলো দলীয়ভাবে তদন্ত হচ্ছে।

বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আগের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি ঘোষণা করায় সেখানেও বিক্ষোভ চলছে। ১৬ ফেব্রুয়ারি কমিটি প্রত্যাখ্যান করে বরিশাল প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন আগের কমিটির নেতারা। তাঁরা নতুন কমিটি বাতিলের দাবি জানান। পরে পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে বর্তমান কমিটির সমর্থকেরা তাতে হামলা করেন।

বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব মিজানুর রহমান সিকদার বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান ও সদস্যসচিব আবুল কালাম সবার অগোচরে বাকেরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে পছন্দের লোকদের নিয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন। কমিটিতে হারুন অর রশিদ জমাদ্দারকে আহ্বায়ক ও নাসির উদ্দিন হাওলাদারকে সদস্যসচিব করা হয়। কমিটির অধিকাংশই বিতর্কিত।

অভিযোগের বিষয়ে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান বলেন, নতুন আহ্বায়ক কমিটি ভোটাভুটির মাধ্যমে হয়েছে। তাঁরা এটি মানেন না, এটা বলার অধিকার তাঁদের আছে। গণতান্ত্রিকভাবে যে কমিটি হয়েছে, এটা তাঁদের পছন্দ হয়নি। কারণ, অর্থের বিনিময়ে আগের কমিটি করা হয়েছিল।