সোহাগ মিয়া
সোহাগ মিয়া

‘একজন ফোন ধইরা কইছে, আফনের ছেলেরে গুলি করছে’

পরিবারের দারিদ্র্য ঘোচাতে বাবার সঙ্গে রাজধানী ঢাকায় রিকশা চালাত সোহাগ মিয়া (১৬)। স্বপ্ন ছিল বাড়তি আয় হলে কিংবা টাকা জমিয়ে গ্রামের বাড়িতে একটি ঘর তুলবে। ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়া চালিয়ে যাবে। মাত্র একটি গুলিতে নিভে গেছে তার জীবনপ্রদীপ। আর সেই স্বপ্নগুলো রইল অধরাই।

গত ১৯ জুলাই বিকেলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার মধ্যে রাজধানীর নয়াবাজার এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় সোহাগ। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে অন্য রিকশাচালকেরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। পরে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। সোহাগ নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার বড়খাপন গ্রামের বাসিন্দা রিকশাচালক শাফায়েত মিয়া ও গৃহিণী শমলা আক্তার দম্পতির ছেলে। গত শনিবার বিকেলে গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সোহাগ ছিল সবার বড়। বছর তিনেক ধরে রাজধানী ঢাকায় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন শাফায়েত মিয়া। সেখানে নয়াবাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। প্রায় দুই বছর আগে বাবার কাছে ঢাকায় যান সোহাগ। বাবা-ছেলে রিকশা চালাতেন।

সোহাগের বাবা শাফায়েত মিয়া বলেন, ‘১৯ জুলাই আসরের নামাজের পর আমার সামনে থাইক্কা রিকশা লইয়া বের হয় সোহাগ। কিছুক্ষণ পর আমারে এক রিকশাচালক ফোন কইরা কইছে, “নয়াবাজার মেইন রোডে গোলাগুলি চলতাছে।” সঙ্গে সঙ্গে আমি ছেলের (সোহাগ) নম্বরে ফোন দিই। একজন ফোন ধইরা কইছে, “আফনের ছেলেরে গুলি করছে। হাসপাতালে লইয়া যাইতাছি।” পরে হাসপাতালে গিয়া দেহি, একটা রুমে আমার ছেলের লাশ ফালাইয়া রাখছে। রুমডাতে আরও অনেক লাশ আছিল।’

‘আমার ছেলে কার কী ক্ষতি করেছিল। তার মাথায় গুলি কইরা মারতে হইছে। সংসারের অভাব দূর করনের লাইগ্গা ছেলেডা ঢাহায় আমার সাথে রিকশা চাইলত। আমি অভাগা বাপ। ছেলেডারে বাঁচাতে পারলাম না। এই হত্যার বিচার হইব কি না, তা জানি না। তবে আল্লার কাছে বিচারের ভার দিলাম
সোহাগের বাবা শাফায়েত মিয়া

‘আমার ছেলে কার কী ক্ষতি করেছিল। তার মাথায় গুলি কইরা মারতে হইছে। সংসারের অভাব দূর করনের লাইগ্গা ছেলেডা ঢাহায় আমার সাথে রিকশা চাইলত। আমি অভাগা বাপ। ছেলেডারে বাঁচাতে পারলাম না। এই হত্যার বিচার হইব কি না, তা জানি না। তবে আল্লার কাছে বিচারের ভার দিলাম,’ অনেক আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন শাফায়েত।

সোহাগের মা শমলা আক্তারের আক্ষেপ আর আফসোস যেন শেষ হচ্ছে না। ছেলের এমন অকালমৃত্যু মেনে নেওয়া তাঁর জন্য মোটেই সহজ নয়। তিনি বলেন, ‘আমার এতটুকু ছেলে কার এমন কী ক্ষতি করছিল? তার মাথাত গুলি কইরা মারণ লাগছে। আমার বুক যারা খালি কইরা দিল, আল্লাহ তাআলা বিচার যেন করেন। আর বিচার কার কাছে চাইয়াম? বিচার চাইয়া লাভ কী হইব, আমার কলিজার টুকরা ধন তো আর ফিরত আইব না।’

কথাগুলো বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন শমলা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ছেলেডা আমারে কইত, “আম্মা, আমি লেহাপড়া করতা পারছি না, ভাইবোনেরা যাতে ইস্কুলে যায়।” ছেলের ইচ্চা আছিল বাড়িত একটা বড় টিনের ঘর তোলার। গুলিতেই আমার সব শেষ হইয়া গেছে।’

ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছেন কলমাকান্দার বড়খাপন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. হাদিচ্ছুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন মৃত্যু সত্যিই আমরা মানতে পারছি না। ছেলেটি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও তাদের পরিবার আমাদের আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবারটির পাশে থাকব।’

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে নেত্রকোনায় এ পর্যন্ত মোট ছয়জনের দাফন হয়েছে বলে জানান নেত্রকোনা জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা)। তিনি বলেন, ওই ছয়জনের মধ্যে সোহাগ মিয়া নামের একজন রিকশাচালকও আছেন।