রংপুরের লালকুঠি মহিলা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের ডিজিটাল ল্যাব। দুই বছর ধরে ল্যাব ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ১৫ মের ছবি
রংপুরের লালকুঠি মহিলা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের ডিজিটাল ল্যাব। দুই বছর ধরে ল্যাব ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ১৫ মের ছবি

সরেজমিন–২

রংপুরে ডিজিটাল শিক্ষা শুধু কাগজেই

রংপুরের সাহেবগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে ‘ডিজিটাল ল্যাব’ চালু হয়েছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ল্যাবে ১১টি ল্যাপটপ এবং একটি করে প্রিন্টার, এলইডি টিভি, স্ক্যানার ও রাউটার থাকার কথা। গত ১২ মে রংপুর শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা গেল, ল্যাব নেই।

এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান বললেন, ল্যাব পাওয়ার কিছুদিন পর পুরোনো আধা পাকা ভবন ভেঙে নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ শুরু হয়। তখন থেকে ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ। ল্যাপটপগুলো ‘সচল’ রাখতে তিনিসহ অন্য শিক্ষকেরা সেগুলো বাড়িতে রেখেছেন।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ছাত্রছাত্রীদের তথ্য ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে দক্ষতা, সক্ষমতা বাড়ানো ও স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। তবে সাহেবগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী সাদিয়া আক্তার ও গোলাম রব্বানি প্রথম আলোকে বলে, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ে তারা শুধু পাঠ্যবই পড়ে। ব্যবহারিক ক্লাসের সুযোগ নেই।

মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদান তথা ডিজিটাল শিক্ষার লক্ষ্যে সারা দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের একাধিক প্রকল্প চলমান।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের দুটি প্রকল্প এবং মাউশির একটি প্রকল্প নিয়ে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এসব প্রকল্পের অধীন সরবরাহ করা ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটার নষ্ট। মাঠপর্যায়ে এগুলোর তদারকি নেই। তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে শিক্ষকদের অদক্ষতাও এসব সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে পড়ে থাকার অন্যতম কারণ।

ডিজিটাল ল্যাব

২০১৫ সালে ‘সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ও ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাব প্রকল্পের (তৃতীয় সংশোধিত)’ মাধ্যমে ৬৪ জেলার ৬৫টি ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাবসহ মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও মাদ্রাসা পর্যায়ের চার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তর। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এ প্রকল্প শেষ হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয় প্রায় ৩৯৮ কোটি টাকা।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তর, রংপুর জেলা কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রংপুর সিটি করপোরেশন ও আট উপজেলার ১১৮টি স্কুল ও কলেজে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়।

সিটি করপোরেশন ও সদর উপজেলার ৩০টি ল্যাবের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছে প্রথম আলো। সরেজমিনে দেখা গেছে, ১৫টি ল্যাবের প্রতিটিতে মাদারবোর্ড, মনিটর ও ব্যাটারির সমস্যার কারণে ১০টির বেশি ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার অচল। একই রকম সমস্যায় নয়টি ল্যাবের প্রতিটিতে পাঁচ থেকে আটটি ল্যাপটপ নষ্ট। সব ল্যাপটপ সচল রয়েছে ছয়টি প্রতিষ্ঠানে।

এসব স্কুল ও কলেজের অন্তত ১০ জন আইসিটির শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, ল্যাপটপগুলো পুরোনো সংস্করণের। অধিকাংশ ল্যাপটপের ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবের (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বে) এস এ এম রফিকুন্নবী প্রথম আলোকে বলেন, ল্যাবগুলো পরিচালনা, সংরক্ষণ ও মেরামতের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। নষ্ট ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ কম্পিউটার মেরামতে আলাদা বাজেট নেই।

এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না হলেও রংপুরের মাহীগঞ্জের ‘সারগাম ক্লাব ও শিক্ষাকেন্দ্র’ ডিজিটাল ল্যাব বরাদ্দ পেয়েছে। স্থানীয় লোকজন বলছে, এটি মূলত সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠন।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের দুটি প্রকল্প এবং মাউশির একটি প্রকল্প নিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এসব প্রকল্পের অধীন সরবরাহ করা ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ কম্পিউটার নষ্ট। মাঠপর্যায়ে এগুলোর তদারকি নেই। তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে শিক্ষকদের অদক্ষতাও এসব সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে পড়ে থাকার অন্যতম কারণ।

ল্যাবের ব্যবহার কম

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০ সালে ডিজিটাল ল্যাব প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে রংপুরে ডিজিটাল ল্যাব পেয়েছে ১০৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সিটি করপোরেশন, রংপুর সদর ও গঙ্গাচড়া উপজেলার ২০টি দ্বিতীয় পর্যায়ের ডিজিটাল ল্যাব ঘুরে দেখা গেছে, অন্তত ১৫টি প্রতিষ্ঠানে ল্যাব নিয়মিত ব্যবহার করা হচ্ছে না।

১১ মে রংপুর শহরের মিস্ত্রিপাড়া সিটি করপোরেশন উচ্চবিদ্যালয়ে ল্যাব দেখতে গেলে আইসিটির শিক্ষক আতিকুর রহমান অভিযোগ করেন—ল্যাপটপগুলোয় অল্প কাজ করতেই হ্যাং হয়ে যায়।

তাজহাট উচ্চবিদ্যালয়ের ল্যাব ঘুরে দেখা গেছে, চেয়ার–টেবিল ও ল্যাপটপগুলোতে জমেছে ধুলা। সহকারী প্রধান শিক্ষক সখিনা বেগম বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষক নেই।

জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এনায়েত হোসেন জানান, রংপুরে মাধ্যমিক ও সমমানের ৭২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি শিক্ষকের ৬৯টি পদ শূন্য।

১১ মে রংপুর শহরের মিস্ত্রিপাড়া সিটি করপোরেশন উচ্চবিদ্যালয়ে ল্যাব দেখতে গেলে আইসিটির শিক্ষক আতিকুর রহমান অভিযোগ করেন—ল্যাপটপগুলোয় অল্প কাজ করতেই হ্যাং হয়ে যায়।

ল্যাব বন্ধ, খোঁজ নেয় না কেউ

২০১৫-১৬ অর্থবছরে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব পায় রংপুর সদরের শ্যামপুর ডিগ্রি কলেজ। প্রতিষ্ঠানটির আইসিটি শিক্ষক মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, কয়েক মাস আগে ল্যাব ভবনটি পরিত্যক্ত হয়েছে। ল্যাবের ল্যাপটপ ও অন্য সরঞ্জাম নতুন একাডেমিক ভবনে রাখা হয়েছে। আইসিটি বিষয়ে ব্যবহারিক ক্লাস হচ্ছে না।

এদিকে শ্যামপুর মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ কাজল মাহমুদ বলেন, ২০২১ সালে করোনায় বন্ধ হওয়ার পর আইসিটি ল্যাবের মনিটরে সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে ল্যাবটি অব্যবহৃত আছে তিন বছর ধরে।

রংপুর সদরের ছয়টি বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেল ল্যাব ব্যবহৃত হচ্ছে না। এসব প্রতিষ্ঠানে ল্যাব বন্ধ এক থেকে দেড় বছর। প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকেরা বলছেন, তাঁরা দক্ষ টেকনিশিয়ান পাচ্ছেন না। প্রকল্প কার্যালয় থেকেও কখনো খোঁজ নেওয়া হয়নি।

তাজহাট উচ্চবিদ্যালয়ের ল্যাব ঘুরে দেখা গেছে, চেয়ার–টেবিল ও ল্যাপটপগুলোতে জমেছে ধুলা। সহকারী প্রধান শিক্ষক সখিনা বেগম বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ের শিক্ষক নেই।

তবে সামান্য কিছু প্রতিষ্ঠানে এমন সমস্যা হয়েছে বলে দাবি প্রকল্প পরিচালক আশফাকুস সালেহীনের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়লে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে জানালে তাঁরা টেকনিশিয়ান দিয়ে সমাধান করে দেন।

তবে বদরগঞ্জের কুতুবপুর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) মমিনুল হকের অভিযোগ, অনেক চেষ্টা করেও টেকনিশিয়ান পাননি।

এমন দুরবস্থার মধ্যেই এ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগের কথা জানান প্রকল্প পরিচালক। তিনি বলেন, আগামী ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা। তবে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার মাল্টিমিডিয়া শিক্ষার ব্যবস্থাপনা করেছে; কিন্তু এটা সচল রাখতে সার্ভিসিংয়ের ব্যবস্থা করেনি। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষক গড়ে তোলা হয়নি। এসব কারণে মাঠপর্যায়ে ডিজিটাল শিক্ষার করুণ দশা হয়েছে। (শেষ)