দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত মোহাম্মদ আলীর স্বজনদের আহাজারি। আজ সোমবার সকালে উপজেলার সিঙ্গুল ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে
দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত মোহাম্মদ আলীর স্বজনদের আহাজারি। আজ সোমবার সকালে উপজেলার সিঙ্গুল ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে

দিনাজপুরে নির্বাচনী সহিংসতা

স্ত্রীর জন্য ওষুধ আনতে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী, ফিরেছেন লাশ হয়ে

স্ত্রীর জন্য চৌরঙ্গী বাজারে ওষুধ কিনতে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী (৬৭)। ওষুধের দোকান থেকে ২০০ মিটার দূরে সিঙ্গুলই হামিদ-হামিদা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান ফটক। গতকাল রোববার সন্ধ্যায় বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে তখন ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা নিয়ে প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা চলছিল। হঠাৎ পুলিশের ধাওয়া ও গুলি ছোড়ার শব্দ। সবাই ছুটে পালিয়েছেন। কিন্তু বয়সের ভারে দৌড় দেওয়া হয়নি মোহাম্মদ আলীর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে রাত সাড়ে আটটায় দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

গতকাল দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় আজিমপুরসহ তিনটি ইউনিয়ন পরিষদের ভোট গ্রহণ করা হয়। আজিমপুরে সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ শেষ হলেও গন্ডগোল বাধে ফলাফল ঘোষণার শেষ মুহূর্তে। বিভিন্ন প্রার্থীর সমর্থক ও উৎসুক জনতা ভোটের ফলাফল নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে নানা গুজব ছড়াতে থাকেন। একপর্যায়ে পুলিশের ওপর চড়াও হয় জনতা। তখন পুলিশের গুলিতে নিহত হন মোহাম্মদ আলী।
নিহত মোহাম্মদ আলী উপজেলার সিঙ্গুল ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় একজন কৃষক। তাঁর তিন মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে; একমাত্র ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী।

নির্বাচনে সদস্য পদে টিউবওয়েল প্রতীকে অংশ নিয়ে জয় পেয়েছেন নিহত মোহাম্মদ আলীর ভাতিজা জোবায়দুর রহমান। তাঁদের বাড়িতে উৎসবমুখর পরিবেশ থাকার কথা থাকলেও তা বিষাদে পরিণত হয়েছে। আজ সোমবার সকালে মোহাম্মদ আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দায় বসে বিলাপ করছেন তাঁর স্ত্রী মরিয়ম বেগম (৫৮)। তাঁর কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন স্বজনেরা। বিলাপ করে মরিয়ম বেগম বলছেন, ‘এ বা ওয় চোর-ডাকাত নাহায় বা, ওয় সাদাসিদা মানুষ। ওয় হজ করি আইছে বা। পাড়ার মানুষেরঠে শুনো ওয় ভালো না খারাপ। মানুষটা এমন করি চলি গেইল বা।’

মোহাম্মদ আলীর বাড়ি থেকে ভোটকেন্দ্রের দূরত্ব প্রায় আধা কিলোমিটার। মরিয়ম বেগম জানান, গতকল সন্ধ্যায় বাড়িতে মাগরিবের নামাজ পড়েছেন তিনি (মোহাম্মদ আলী)। পরে ওষুধসহ কিছু বাজার করার জন্য বের হন। ভোটের ফলাফল নিয়ে ভাতিজাসহ অন্যরা যখন বাসায় ফিরেছেন, তখন স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। কিন্তু কেউ বলতে পারছিলেন না। হঠাৎ কেউ একজন ফোনে জানান ভোটকেন্দ্রে গন্ডগোল লাগছে; তাঁর (মোহাম্মদ আলী) গায়ে গুলি লাগছে।

আজ সকাল সাড়ে নয়টায় চৌরঙ্গী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, দুয়েকটি বাদে প্রায় দোকানপাট বন্ধ। চায়ের দোকানে বসে গতকালের ঘটনার কথা  আলোচনা করছেন লোকজন। তাঁদেরই একজন রাজকুমার রায়। ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তিনি বলেন, ভোট গ্রহণ ও গণনা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। সদস্য পদে মোরগ মার্কার প্রার্থীর এজেন্ট পুনরায় ভোট গণনার দাবি করেছিলেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবার ভোট গণনা করেছেন। ফল মেনেও নিয়েছেন সবাই। মাইকে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও সবাই কাগজ চায় (ফলাফল শিট)। চেয়ারম্যান পদের ফলাফলের কাগজ চায় লোকজন। পুলিশ দুবার ধাওয়া দিয়ে লোকজনকে সরিয়ে দিয়েছে। পরে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার সময় ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে মানুষ। এর কিছু সময় পরেই গুলি ছোড়ে পুলিশ।

নিহত মোহাম্মদ আলীর ভাতিজা ও বিজয়ী ইউপি সদস্য জোবায়দুর রহমান আজ বেলা পৌনে একটার দিকে জানান, দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের মর্গ থেকে চাচার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। দুপুরে জানাজা শেষে সিঙ্গুলই স্কুলের পাশেই কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।