অ্যাসিডে দগ্ধ হয়ে ১০ দিন ধরে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের শয্যায় কাতরাচ্ছেন সাদিয়া আক্তার (২০)। মুখমণ্ডল দগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে গভীর ক্ষত। শরীরের ২৭ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় এখনো শঙ্কামুক্ত নন তিনি।
সাদিয়ার বাড়ি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার মাদবরেরচর এলাকায়। মেয়ের এমন পরিণতি কোনোভাবেই মানতে পারছেন না তাঁর মা-বাবা। হাসপাতালে ভর্তির শুরু থেকে মেয়েকে সুস্থ করে তুলতে মা নূর জাহান বেগম লড়াই করে যাচ্ছেন। আজ শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাইয়াডা আমার আর ভালো হইবে না। বিছানায় কাতরাচ্ছে। ওর অনেক কষ্ট হইতাছে। মা হইয়া মাইয়াডার এমন কষ্ট আর লইতে পারতাছি না। বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার।’
সাদিয়ার ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনায় অভিযুক্ত তাঁর সাবেক স্বামী সুমন শিকদারকে গত বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে এতেও সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন না নূর জাহান বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার মাইয়াডার এমন ক্ষতি যে করছে, ওই সুমনের বিচার চাই আমরা। ওরে পুলিশ ধরছে, এতে আমরা খুশি না। ওর বিচার হইতে হবে। ওর ফাঁসি চাই আমরা।’
পুলিশ ও মামলার এজাহার সূত্র জানায়, চার বছর আগে শিবচরের মাদবরেরচর এলাকার স্পিডবোটচালক সুমন শিকদারের সঙ্গে একই এলাকার লিটু হাওলাদারের মেয়ে সাদিয়া আক্তারের বিয়ে হয়। তাঁদের ঘরে এক কন্যাসন্তানও রয়েছে। সংসারের শুরু থেকে সুমনের কাজে অনীহা ও মাদকাসক্ত হওয়ায় অশান্তি লেগে ছিল। একপর্যায়ে সাদিয়া তাঁকে তালাক দিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসে। এর কয়েক মাস পর সাদিয়ার অন্যত্র বিয়ে ঠিক করে পরিবার। সুমনের কাছে এ খবর পৌঁছালে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
এর জেরে ১৬ আগস্ট রাত ১০টার দিকে সুমন তাঁর লোকজন নিয়ে সাদিয়ার বাড়িতে হামলা চালান। এ সময় বাধা দিতে গেলে সাদিয়াকে লক্ষ্য করে অ্যাসিড ছুড়ে মারেন সুমন। অ্যাসিডে সাদিয়ার মাথা, মুখমণ্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ মারাত্মকভাবে ঝলসে যায়। পরবর্তী সময়ে স্বজনেরা তাঁকে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। চিকিৎসক ওই দিন রাতে তাঁকে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠান।
এ ঘটনার এক দিন পরই ভুক্তভোগী সাদিয়া আক্তারের বোন তাছলিমা আক্তার বাদী হয়ে শিবচর থানায় অ্যাসিড অপরাধ দমন আইনে একটি মামলা করেন। এতে পাঁচজনকে এজাহারভুক্ত ও অজ্ঞাতনামা দুই থেকে তিনজনকে আসামি করা হয়।
তাছলিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বোন নতুন করে তার জীবন সাজাতে চেয়েছিল। চেয়েছিল নতুন করে বাঁচতে। কিন্তু ওই সুমন সব আশা শেষ করে দিল। সাদিয়ার সামনের দিনগুলো জানি না কেমন কাটবে? তবে ওর সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। বেঁচে ফিরলেও সারা জীবন মরার মতো হয়ে থাকতে হবে। তবুও চাই, বোনটা আমার বেঁচে থাকুক।’
এ সম্পর্কে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও শিবচর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইজারত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা পলাতক ছিলেন। পরে গোয়েন্দা পুলিশ ও থানা–পুলিশের সহযোগিতায় প্রধান অভিযুক্তসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রধান আসামি সুমন শিকদার তাঁর অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন। এ ঘটনার সঙ্গে আরও যাঁরা জড়িত, তাঁদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
চিকিৎসকের বরাত দিয়ে পরিবারের সদস্যরা জানান, সাদিয়ার অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক। অ্যাসিডে তাঁর শরীরের ২৭ শতাংশ পুড়ে গভীর ক্ষত হয়ে গেছে। তাঁর সুস্থ হয়ে উঠতে সময় লাগবে।
সাদিয়ারা তিন বোন ও দুই ভাই। ছোট ভাই অনিক হাওলাদার ঘটনার পর থেকে সারাক্ষণ হাসপাতালে অবস্থান করছেন। অনিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে সেবা পাচ্ছি। কিছু ওষুধ কিনতে হচ্ছে, কিছু হাসপাতাল থেকে দিচ্ছে। চোখের সামনে বোনটা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমি কিছুই করতে পারছি না।’
এ ঘটনার খবর পেয়ে প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে সাদিয়ার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ট্রাস্টের একটি প্রতিনিধিদল বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়ে চিকিৎসার খোঁজখবর নেয়। এ সময় তাঁরা সাদিয়ার পরিবারকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।
মাহবুবা সুলতানা বলেন, প্রথম আলো সহায়ক তহবিলের মাধ্যমে এ পর্যন্ত সাড়ে চার শতাধিক অ্যাসিডদগ্ধ নারীকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ জনকে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও পুঁজি দিয়ে, দোকান তৈরি করে দিয়ে, রিকশা/ভ্যান, ভূমিহীন নারীকে জমি কিনে দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয়। কম্পিউটার ও সৌন্দর্যবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ৩৫ জনকে। শিক্ষা সহায়তা পান ১৭ জন এবং চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয় ১০১ জনকে। আইনি সহায়তা দেওয়া হয় চারজনকে।