এলাকায় ১০ হাজার একরে আখ চাষ হতো। এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ১০ সহস্রাধিক চাষি। কিন্তু লোকসানের অজুহাতে ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার একমাত্র ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান শ্যামপুর চিনিকল বন্ধ থাকায় ওই সব জমিতে আখ চাষ করছেন না চাষিরা। কিন্তু জমিগুলোতে অন্য ফসল চাষে তাঁরা তেমন লাভবানও হচ্ছেন না। এতে ক্রমান্বয়ে ওই চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
১০ সেপ্টেম্বর ওই মিল চালু করার বিষয়ে শ্যামপুর বাজারে চাষিরা মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন। এ সময় বাংলাদেশ আখচাষি ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরীর আন্তরিকতার অভাবে ওই চিনিকল চালু হয়নি। তিনি (সংসদ সদস্য) চেয়েছিলেন চিনিকলটি সালমান এফ রহমানের অধীনে ছেড়ে দিতে। সেই লক্ষ্যে সংসদ সদস্য অপচেষ্টাও চালিয়েছেন। কিন্তু সরকারের পতন হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে চিনিকলটি বন্ধ থাকায় এলাকার আখচাষিরা কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।
অর্থনৈতিকভাবে তাঁরা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। বন্ধ থাকায় চিনিকলকে ঘিরে এলাকার ব্যবসা–বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চিনিকলের মৌসুমি অনেক শ্রমিকও বেকার হয়েছেন। এ দুরবস্থা কাটাতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানববন্ধনে চাষিরা দাবি জানিয়েছেন, ওই চিনিকলটি পুনরায় চালু করার।
ওই চিনিকল সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে লোকসানের অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকার চিনিকলটি বন্ধ ঘোষণা করে। এর পর থেকে আখচাষি ফেডারেশনের পক্ষ থেকে দাবি জানানো হলেও চিনিকলটি আওয়ামী লীগ সরকার আর চালু করেনি।
চিনিকল সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৪ সালে বদরগঞ্জের শ্যামপুর এলাকায় প্রায় ১১১ দশমিক ৪৫ একর জমিতে চিনিকলটি স্থাপিত হয়। ১৯৬৭ সালে আখমাড়াই শুরু হয়। সক্ষমতা ছিল দৈনিক ১ হাজার ১৬ মেট্রিক টন আখমাড়াইয়ের। বার্ষিক চিনি উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১০ হাজার ১৬১ মেট্রিক টন। ২০২০ সাল পর্যন্ত চিনিকলে স্থায়ী-অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন ৭৪৪ জন। বর্তমানে আছেন ৬১ জন। ২২৬ কোটি টাকা লোকসানের মুখে ২০২০-২১ অর্থবছরে ওই চিনিকলে আখমাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে চিনিকলের দায়িত্বে থাকা ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাঁচ মাস ধরে বেতন–ভাতা না পেয়ে মানববেতর জীবন যাপন করছেন।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, চিনিকল চত্বর গাছগাছালিতে ভরা। নেই কোনো কোলাহল বা যান্ত্রিক শব্দ। চিনিকলের প্রধান ফটকে বসে ছিলেন দুজন নিরাপত্তাকর্মী। তাঁদের সঙ্গে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, আখ পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত ট্রাক্টর-ট্রলিগুলো অযত্ন–অবহেলায় পড়ে রয়েছে। ঝোপঝাড় ও লতাপাতায় সেগুলো ঢেকে গেছে। রোদ–বৃষ্টিতে মরিচা পড়ে তা নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। যত্রতত্র পড়ে আছে চিনিকলে ব্যবহৃত মূল্যবান যন্ত্রাংশ। এ সময় নিরাপত্তাকর্মী মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আখ পরিবহন কাজে ব্যবহৃত গাড়ি এবং চিনিকলের অনেক যন্ত্রাংশ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেখার কেউ নেই। চিনিকল বন্ধ থাকায় পাঁচ মাস ধরে বেতন–ভাতা না পেয়ে আমরা খুব কষ্টে আছি।’
শ্যামপুর গ্রামের আখচাষি ফজলুল হক বলেন, ‘তিনি আগে দেড় একরে আখ চাষ করতেন। এখন করেন না। কিন্তু আখ আমাদের এলাকার প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল। আগে আখ চাষ করে বছরে যে পরিমাণ টাকা লাভ হতো, এখন একই পরিমাণ জমিতে অন্য ফসল চাষে তিন ভাগের এক ভাগও লাভ হচ্ছে না। এতে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছি।’
আরেক চাষি জয়নাল হোসেন বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময় মিল চালুর জন্য আন্দোলন–সমাবেশ করেছি, কাজ হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের প্রাণের দাবি হচ্ছে, তিনি যেন চিনিকলটি চালু করে এ অঞ্চলের মানুষকে অর্থনৈতিক দৈন্য থেকে বাঁচান।’
অন্তত ১৫ জন চাষি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে কারখানাটি বন্ধ থাকায় চিনিকলের অনেক যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, আখ পরিবহনে এবং কর্মকর্তার কাজে ব্যবহৃত গাড়ির চাকাসহ অন্য যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করা হচ্ছে। চিনিকলের অফিশিয়াল আসবাবপত্র অনেকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন। চত্বরে থাকা গাছ কেটেও লুটপাট করা হচ্ছে।
শ্যামপুর আখচাষি কল্যাণ কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন বলেন, ‘চিনকলটি বন্ধ থাকায় এলাকার অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমাদের এই অঞ্চল থেকে কোটি কোটি টাকা মানি সার্কুলার হতো। গ্রামে থেকেও আমরা শহুরে জীবন যাপন করতাম। বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে আমরা বাস করছি। অন্য ফসল চাষ করে আখচাষিরা সংসারের খরচ চালাতে পারছেন না। আমাদের একমাত্র প্রাণের দাবি শ্যামপুর চিনকল পুনরায় চালু করা হোক। তাহলে এই অঞ্চলের কৃষক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটবে। এতে করে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার হবে।
জানতে চাইলে শ্যামপুর চিনিকলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ইনচার্জ) মাসুদ সাদিক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা চিনিকলটি পুনরায় চালুর দাবি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অসংখ্যবার আবেদন করেও ফল হয়নি। আমরা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন–ভাতাও পাচ্ছি না। এ অবস্থায় পরিবার–পরিজন নিয়ে ভীষণ কষ্টে আছি। অন্তর্বর্তী সরকার চিনিকলটি চালু করবে—এমন আশায় বুক বেঁধে আছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যন্ত্রাংশ পড়ে থাকলে নষ্ট হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। চিনিকল চত্বরে চুরি ও গাছপালা লুট যেন না হয়, সে ব্যাপারে আমরা সজাগ রয়েছি।’