ফয়সাল খান
ফয়সাল খান

ফেলে দিয়ে হত্যা, নাকি নিজেই লাফিয়ে পড়েছেন, তদন্ত করছে পুলিশ

ময়মনসিংহে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অভিযানের পর পাঁচতলা ভবনের ছাদ থেকে পড়ে ফয়সাল খান নামের এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনার ১৮ দিন পার হলেও পুলিশ এর রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে পারেনি।

পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ফয়সালকে ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে, নাকি নিজেই ছাদ থেকে লাফ দিয়েছেন—এ দুটি বিষয় ধরে তদন্ত করছে পুলিশ।
এদিকে এ ঘটনায় পুলিশ মামলার এজাহারভুক্ত এক আসামি ও সন্দেহভাজন দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল বুধবার দুজনকে এক দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত।

নিহত ফয়সাল খান (৩০) ওরফে শুভ ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সরিষা কাশিপুর এলাকার সেলিম খানের ছেলে। তিনি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করে নগরের কেওয়াটখালী পাওয়ার হাউস রোডে বড় বোনের বাসায় থেকে চাকরির চেষ্টা করছিলেন।

স্বজনেরা জানান, প্রতিবেশী এক তরুণীর সঙ্গে প্রেম ছিল ফয়সালের। মেয়েটির বিয়ে ঠিক হওয়ায় তা ভাঙার চেষ্টা করছিলেন ফয়সাল। এ ঘটনায় ফয়সাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে ঈশ্বরগঞ্জ থানায় মামলা করেন ওই তরুণীর বাবা। ১০ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিটে মামলা হয়। কিন্তু এর আগেই রাত ৯টা ৩৮ মিনিটে ফয়সালের বোনের বাসা নগরের কেওয়াটখালী পাওয়ার হাউস রোডে অভিযানে যায় ডিবি। সঙ্গে ছিলেন তরুণীর এক খালাতো ভাই ও অপর এক যুবক। ডিবি অভিযান শেষে রাত ৯টা ৫৬ মিনিটে বেরিয়ে যাওয়ার পর পাঁচতলা ভবনের নিচ থেকে ফয়সালকে রক্তাক্ত ও অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেন স্বজনেরা। ১৫ নভেম্বর ঢাকার নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় ১২ নভেম্বর কোতোয়ালি মডেল থানায় ফয়সালের বাবা সেলিম খান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এজাহারে ডিবি পুলিশ পরিচয়ধারী লোকের সঙ্গে বাসায় ঢুকে আসামিরা হত্যার উদ্দেশ্যে ধাক্কা দিয়ে ফয়সালকে বাসার নিচে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ করা হয়। মামলায় তরুণীর বাবাসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করা হয়।

সেলিম খান বলেন, ফয়সালের সঙ্গে ঘটনার আগের দিন তাঁর চাচাকেও মারধর করা হয়েছিল। মীসাংসার আলাপ চলছিল; এর মধ্যে বাসায় ডিবি অভিযানে যায়। শুধু ডিবি পুলিশ গেলে এমন ঘটনা ঘটত না; সঙ্গে যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁরা জানতেন ফয়সাল কোথায়। তাঁরা সরাসরি সেখানে চলে যান। তাঁরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছেন।

এ সম্পর্কে ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি আশরাফুর রহমান বলেন, ‘অভিযানের সময় বাদীপক্ষের লোক সঙ্গে নেওয়াতে আইনগত কোনো বিপত্তি নেই। বাদী (ফয়সালের পরিবার) আমার কাছে এসেছিলেন। ডিবি পুলিশের দৃষ্টির বাইরে তাঁরা যাননি, তাঁদের নিয়েই তল্লাশি করা হয়েছে। তরুণীর পরিবারের লোক যাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন, তাঁরা ওপরে গেলেন কি না, সে বিষয় নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন বাদীপক্ষের লোক। তরুণীর পরিবারের দুজন হয়তো এদিক–ওদিক যেতে পারেন। যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁদের আসামি করে মামলাও করেছেন। ইতিমধ্যে কয়েকজন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তদন্ত করে দেখা হচ্ছে, ধাক্কা দেওয়া হয়েছে, নাকি ফয়সাল ওখান থেকে ভয়ের চোটে লাফ দিয়ে পড়ে মারা গেছেন।’

অভিযানে বাদীপক্ষের লোক না নিয়ে পুলিশের সোর্স নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন ময়মনসিংহ আদালতের আইনজীবী এম এ হান্নান খান। তিনি বলেন, পুলিশের প্রত্যেক জায়গায় সোর্স আছে, চিনতে না পারলে সোর্স নেওয়া যেত। এসব ক্ষেত্রে ক্ল্যাশ (সংঘর্ষ) হতে পারে, সে কারণে কখনো প্রতিপক্ষকে সঙ্গে নিতে হয় না বা অবস্থান করতে দেওয়া উচিত নয়। এতে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পুলিশের সঙ্গে বাদীপক্ষের লোক থাকায় ঘটনাটি ঘটেছে, সঙ্গে না থাকলে হয়তো ঘটত না।

ডিবির অভিযানের সময় সঙ্গে ছিলেন ফয়সাল খানের ভগ্নিপতি মোহসিনুল হক। তিনি বলেন, ‘পুলিশের তৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে, প্রকৃত ঘটনা উদ্‌ঘাটনে তাদের প্রচেষ্টা রয়েছে। ইতিমধ্যে তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে সেদিন ডিবির সঙ্গে ভেতরে যাওয়া দুজন গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত রহস্য জানা যাবে না। গাফিলতি আছে কি না, সেটি তদন্ত করছে, শুনেছি। আশা করছি, নিয়মের বাইরে কিছু হয়ে থাকলে তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

দুই আসামি এক দিনের রিমান্ডে
ফয়সাল খানের মৃত্যুর ঘটনায় কক্সবাজার থেকে গত শুক্রবার রাতে গ্রেপ্তারের ফরহাদ তানভীর তুষার (২৫) ও কাউছার মিয়া নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত রোববার তাঁদের আদালতে সোপর্দ করে পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন জানায় পুলিশ। গতকাল বুধবার দুপুরে বিচারক এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বলে জানিয়েছেন আদালত পরিদর্শক মোস্তাছিনুর রহমান।

কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সফিকুল ইসলাম খান বলেন, ইতিমধ্যে তিনজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে তা বলা যাচ্ছে না। তবে অভিযানের সময় ভেতরে যে দুজন ছিলেন, তাঁদের ধরতে চেষ্টা চলছে। তাঁরা ধরা পড়ার পর প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।

তদন্ত শেষ হতে সময় লাগবে
এ ঘটনায় পুলিশের কোনো ব্যত্যয় আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় ১৭ নভেম্বর রাতে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। এ বিষয়ে জানতে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) শামীম হোসেনের সঙ্গে গতকাল কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। তদন্ত কমিটির সদস্য ময়মনসিংহ আদালত পরিদর্শক মোস্তাছিনুর রহমান বলেন, তদন্ত শেষ হতে কিছুটা সময় লাগবে।