ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে ‘টর্চার সেল’ বানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আফতাব উদ্দিন ওরফে রাব্বী। চাঁদা না পেলে তাঁর ‘আব্বা বাহিনী’ দিয়ে মানুষকে তুলে এনে সেখানে নির্যাতন চালানো হতো। ওই ‘টর্চার সেলে’ নির্যাতনে এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠার পর এসব কথা জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
আফতাব উদ্দিন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর বাবা বাছের উদ্দিন শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তাঁর চাচা ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তাঁদের ক্ষমতায় আফতাব স্বেচ্ছাসেবক লীগের পদ বাগিয়ে নেন। এর পর থেকে তিনি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তাঁর বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হওয়ার কথা জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তাঁর সেই কার্যালয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের যাতায়াতের তথ্যও পাওয়া গেছে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের তেলঘাট সড়ক এলাকায় পারভীন টাওয়ারের নিচতলায় আফতাব উদ্দিনের ব্যক্তিগত কার্যালয়টি অবস্থিত। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেল (৩২) নামের এক যুবককে মুঠোফোনে সেখানে ডেকে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয় বলে অভিযোগ পরিবারের। যাতে মৃত্যু হয় সাইফুলের। এ ঘটনায় আফতাব উদ্দিনসহ ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছে পরিবার। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও ১০ থেকে ১২ জনকে। তবে এই ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। হত্যার অভিযোগ ওঠায় আফতাবকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ।
অভিযোগের বিষয়ে আফতাব উদ্দিন ও তাঁর বাবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে বন্ধ পাওয়া যায়। এলাকায় গিয়েও তাঁদের পাওয়া যায়নি। তবে হত্যার ঘটনার পর আফতাবের চাচা ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শুভাঢ্যা ইউপির চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘যে মারা গেছেন, সে ব্যক্তি চাঁদাবাজ ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অপকর্মের অনেক অভিযোগ রয়েছে। রাব্বির (আফতাব) বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে।’
চাঁদা না পেলেই আনা হয় টর্চার সেলে
গত শনিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শুভাঢ্যা ইউনিয়নের তেলঘাট সড়কে গিয়ে দেখা যায়, আফতাবের ব্যক্তিগত কার্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। ভবনের বাসিন্দা ও দোকানিরা অপরিচিত কাউকে দেখলে সটকে যাচ্ছেন। কার্যালয়ের আশপাশে বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ।
নাম প্রকাশ না করে স্থানীয় বাসিন্দা বলছেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আফতাব স্থানীয় মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ ছাড়া চাঁদাবাজি, সালিস ও পাওনা টাকা আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি কিংবা মাদক ব্যবসায়ে বাঁধা দিলে ব্যক্তিগত কার্যালয়ের অভ্যন্তরে ‘টর্চার সেলে’ এনে অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো। এই কাজের জন্য তিনি গড়ে তুলেছেন ‘আব্বা বাহিনী’। এ বাহিনীর সদস্য অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে এই বাহিনীর কয়েকজন সদস্যের নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন আলমগীর হোসেন ওরফে ঠান্ডু আলমগীর, মো. সজিব, দেলোয়ার হোসেন দেলু, অপু আহমেদ, রনি মিয়া ওরফে ভাইস্তা রনি, রিপন মিয়া ওরফে তোতলা রিপন, রাজীব মিয়া, মো. হিরা, জুম্মন আলী, মো. হিরণ, রাকিব হোসেন, রাশেদ আলী ও শিপন হোসেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চর কালিগঞ্জ এলাকার এক ঝুট ব্যবসায়ী বলেন, তিনি গাজীপুর থেকে ঝুট কিনে এনে এ এলাকায় বিক্রি করেন। তিন মাস আগে আফতাব উদ্দিন তাঁকে কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে বলেন, এখানে ব্যবসা করতে হলে তাঁর কাছে ঝুট বিক্রি করতে হবে। রাজি না হওয়ায় তাঁরা পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। একপর্যায়ে নির্যাতনের ভয় দেখানো হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি বাধ্য হয়ে তাঁদের সাড়ে তিন লাখ টাকা দেন। এ বিষয়টি কাউকে না জানাতে হুমকি ও প্রাণনাশের ভয় দেখানো হয়।
খেজুরবাগ সাতপাখি এলাকার এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘বছরখানেক আগে এ এলাকায় জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করি। কাজ শুরুর সপ্তাহখানেকের মধ্যে আফতাব লোকজন মারফত খবর পাঠিয়ে তেলঘাট এলাকায় তাঁর কার্যালয়ে যেতে বলেন। সেখানে গেলে আফতাব তাঁকে বলেন, “আমার এলাকায় নতুন বাড়ি বানাইসেন কিন্তু আমার লোকজনের কাছ থেকে ইট, বালু, সিমেন্ট নেন নাই, এটা তো ঠিক করেন নাই। এখানে বাড়ি বানাইতে হলে আমাগো তিন লাখ টাকা দিতে হইব। নয়তো বাড়ির কাজে আর হাত দিতে পারবেন না।”’ ওই বাসিন্দা আরও বলেন, ‘তাঁদের দাবি করা টাকা না দিতে চাইলে আফতাব ও তাঁর লোকজন আমাকে চড়থাপ্পড় মারেন। পরে আমি বাধ্য হয়ে অনেক আকুতি–মিনতি করে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিই।’
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চর কালিগঞ্জ এলাকার গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মওদুদ ভূঁইয়া বলেন, আফতাব তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কালিগঞ্জ, চর কালিগঞ্জ, খেজুরবাগ, চুনকুটিয়া ও পূর্ব আগানগর এলাকার গার্মেন্টসপল্লির ঝুটের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি ব্যবসায়ীদের ন্যায্য মূল্যের চাইতে কম দামে ঝুট বিক্রি করতে বাধ্য করতেন। কেউ কথা না শুনলে কিংবা প্রতিবাদ করলে ‘টর্চার সেলে’ এনে নির্যাতন করা হতো।
কার্যালয়ে পুলিশ কর্মকর্তার যাতায়াত
আফতাবের ওই ব্যক্তিগত কার্যালয়ে যাতায়াত ছিল দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার। সাইফুল হত্যাকাণ্ডের চার দিন আগে ৫ জানুয়ারি আফতাব উদ্দিনের ফেসবুক আইডি থেকে তাঁর কার্যালয়ের কয়েকটি ছবি পোস্ট করা হয়। সেখানে পরিদর্শক মাসুদুর রহমানের সঙ্গে আফতাব উদ্দিন ও তাঁর সহযোগীরাসহ সাইফুলের হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখা যায়। ওই পোস্টে লেখা ছিল, ‘দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার তদন্ত ওসি মাসুদুর রহমান মামার সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা।’
জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান বলেন, ‘কাজের প্রয়োজনে সেখানে (আফতাব উদ্দিনের ব্যক্তিগত কার্যালয়) গিয়েছিলাম। কাজের প্রয়োজনে সেখানে যেতেই পারি। আমার সঙ্গে আফতাবের ব্যক্তিগত কোনো সম্পর্ক নেই।’
যেভাবে সাইফুলকে নির্যাতন করে হত্যা
শুভাঢ্যা ইউনিয়নের খেজুরবাগ নার্সারি গলির মোজাম্মেল মিয়ার বাড়ির নিচতলায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন সাইফুল ইসলাম। শনিবার বেলা তিনটার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটকের সামনে কয়েকজন উৎসুক মানুষ জড়ো হয়েছেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁদের একজন বলেন, হত্যাকাণ্ডের চার দিন হলো। অথচ এখনো পুলিশ আসামিদের ধরছে না। আসামি ও তাঁর পরিবার ক্ষমতাশালী হওয়ায় এখনো তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ভেতরে গিয়ে দেখা যায় সাইফুলের স্ত্রী মৌসুমি আক্তার (সুমি) ও ছোট বোন নাজমা বেগম ঘরে বসে আছেন।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মৌসুমি আক্তার বলেন, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে এক ব্যক্তি ফোন করে জানান, তাঁর স্বামীকে আফতাব কার্যালয়ে মারধর করছেন। খবর পেয়ে তৎক্ষণিক তিনি ছুটে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন, সাইফুল অচেতন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছেন। তাঁর মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়েছে। একপর্যায়ে আফতাব মৌসুমিকে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘২০ লাখ টাকা দিয়ে তর স্বামীর লাশ এখান থেকে নিয়ে যাবি।’ এরপর তিনি বাসায় চলে আসেন।
পরে ভোর দিকে আফতাবসহ তাঁর ৯ সহযোগী সাইফুলকে অচেতন অবস্থায় বাসায় নিয়ে আসেন বলে জানান মৌসুমি। তিনি আরও বলেন, ‘আমি আফতাব ও তাঁর সহযোগীদের পায়ে ধরে স্বামীকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে আকুতি জানাই। আমার মেয়েও অনেক আকুতি করেছে। কিন্তু তা–ও তাঁদের মন গলেনি। বরং আফতাব তখন হেসেছেন। একপর্যায়ে তাঁরা আমাদের ঘরে থাকা চেক বই, নগদ টাকা ও মুঠোফোন নিয়ে যায়। পরে স্বামীকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।’
সাইফুলকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে মৌসুমি আক্তার বলেন, ‘ঘটনার পর আফতাবের বাবা আমার মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে তাঁদের সাজানো মতো বক্তব্য পুলিশের কাছে দিতে বলেছে।’ বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামী মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাজনীতি ছেড়ে বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এতে রাব্বী ও তাঁর বাহিনী স্বামীর ওপর ক্ষিপ্ত হয়। এটাই তাঁর কাল হলো।’
সাইফুল ইসলামকে নির্যাতনের বেশকিছু ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সাইফুল আহত অবস্থায় আফতাব উদ্দিনকে বলছেন, ‘আব্বা, আপনি আমার বাপ। আব্বা, আব্বা, আব্বা আপনি আমাকে বাঁচান।’ এমন আকুতি অবস্থায়ও কয়েকজন যুবক রাসেলকে টানাহেঁচড়া করে পেছন দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। আরও একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মেঝেতে রাসেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে নীলফুলা জখম ও নির্যাতনের চিহ্ন। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। তখন কেউ একজন নাকের রক্ত মুছে দিচ্ছেন।
দায় নেবে না স্বেচ্ছাসেবক লীগ
গত শুক্রবার কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের দপ্তর সম্পাদক আজিজুল হক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সাইফুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় আফতাব উদ্দিনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানিয়ে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাইফুলকে নির্যাতনের ঘটনা পুরো বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে। আফতাব উদ্দিনকে দল থেকে বহিষ্কার করেছি। কোনো ব্যক্তির দায় সংগঠন নেবে না।’
ভিডিও দেখে হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কেরানীগঞ্জ সার্কেল) শাহাবুদ্দীন কবীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় বেশ কিছু ক্লু (সূত্র) পেয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা যতই প্রভাবশালী ব্যক্তি হোক না কেন, তাঁদের শিগগিরই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’