কুষ্টিয়ায় দুই উপজেলায় শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশের নামে নবীন ও প্রবীণ নেতাদের মধ্যে কাদা-ছোড়াছুড়ি ও বিষোদ্গার নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন কর্মীরা। সম্প্রতি নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
দলীয় কর্মীরা বলছেন, নবীন ও প্রবীণের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকেই বিরোধের সূত্রপাত। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কুমারখালী ও খোকসা আওয়ামী লীগের নবীন ও প্রবীণ নেতাদের মধ্যে ‘বাগ্যুদ্ধ’ জনসমক্ষে এসেছে।
এই বাগ্যুদ্ধের এক পক্ষে আছেন কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনের সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ ওরফে জর্জ। অপর পক্ষে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদর উদ্দীন খান, সাধারণ সম্পাদক আসগর আলী, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি জাহিদ হোসেন জাফর ও কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মান্নান খান। গত ৯ দিনে এই দুই পক্ষ পাঁচটি সমাবেশের আয়োজন করে। এর মধ্যে সেলিম আলতাফের অনুসারীরা দুটি আর সদর খানের অনুসারীরা তিনটি সমাবেশের আয়োজন করেন।
সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রবীণ এই নেতারাই সেলিম আলতাফের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিলেন। এবার নির্বাচনের কয়েক মাস আগেই তাঁরা সেলিমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন। সংসদীয় ওই আসনে অন্য কাউকে মনোনয়ন চান তাঁরা।
সম্প্রতি কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসগর আলীর ‘রাতের অন্ধকারে তোমরা এমপি হয়েছ, আমরাই তো তৈরি করেছি’—এমন মন্তব্য আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এর আগে সমাবেশ করে সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ বলেছিলেন, ‘আপনারা বয়স্ক মুরব্বি মানুষ। আমি কোনো আজেবাজে কথা বলতে চাই না। যদি কথা বলেন, সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি। কিসের রাজনীতি করেন আপনারা? আমরা কি এখানে হাতে চুড়ি পরে বসে আছি?’
দুই পক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি পক্ষ সৃষ্টি হয়ে গেছে। অনেকেই এই মনোনয়ন দৌড়ে দৌড়াতে গিয়ে একে অপরকে নিয়ে বিষোদ্গার করছেন। তৃণমূলে কিছুটা হলেও এর প্রভাব পড়ছে।
স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান কুমারখালী উপজেলার কিবরিয়া পরিবারের সন্তান সেলিম আলতাফ। তাঁর দাদা গোলাম কিবরিয়া বঙ্গবন্ধুর সহচর ছিলেন। ছিলেন সংসদ সদস্য। সেলিমের চাচা ও চাচিও ছিলেন সংসদ সদস্য। তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে সেলিম মনোনয়ন পান। সেলিম আলতাফ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য। কুমারখালী ও খোকসায় সেলিমের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি বড় বলয় তৈরি হয়। সেলিমের চাচা শামসুজ্জামান অরুণ কুমারখালী পৌরসভার মেয়র। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এলাকায় সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করেন।
কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মান্নান খান ও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক জাহিদ হোসেনের সঙ্গে সেলিমের পারিবারিক বিরোধ চলছে। এই দুই উপজেলায় সদর খান ও সেলিমের অনুসারীরা দলীয় অনুষ্ঠানগুলো পৃথকভাবে পালন করে আসছেন।
সংসদ সদস্যের অনুসারীরা বলছেন, এই আসনে সেলিম তরুণ নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর নেতৃত্ব দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মানতে অনীহা। সংসদ নির্বাচনে সেলিমই আবার মনোনয়ন পাবেন—এমন ভাবনা থেকেই নেতারা বিষোদ্গার করছেন।
আর সদর উদ্দীন খান ও আবদুল মান্নান খানের অনুসারীরা বলছেন, সংসদ সদস্যের এলাকায় গণসংযোগ নেই। তাঁর পেছনে কোনো লোকজনও নেই।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসগর আলী বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে কোনো বিষোদ্গার করা হয়নি। সেলিম তরুণ সংসদ সদস্য। সে যখন মনোনয়ন পেয়েছিল, তখন তার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দিনরাত সভা-সমাবেশ করে এমপি বানানো হয়েছিল। তার দাদার সঙ্গে রাজনীতি করেছি। তার সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই। তবে দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যখন সমালোচনা করা হয়, তখন কষ্ট লাগে।’
সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যক্তি ও পরিবার নিয়ে বিষোদ্গার করা হয়েছে। এটা কাম্য নয়। রাজনীতি নিয়ে বিরোধ থাকতেই পারে। তাই বলে ব্যক্তিগত আক্রোশ থাকা ঠিক নয়। আর সাধারণ সম্পাদক যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা আমি না, পুরো দলের বিরুদ্ধে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার দুরভিসন্ধি। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীসহ দলীয় ফোরামে জানানো হবে।’
রাজনীতিতে শালীনতা বজায় রাখা উচিত বলে মনে করেন সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতিতে একে অপরের প্রতি সম্মান রাখতে হবে। দোষ-ত্রুটি থাকতেই পারে। সেটা নিজেদের ঘরোয়া বৈঠকে নিরসন করা উচিত। জনসমক্ষে বলা দুঃখজনক।