খুলনার দৌলতপুর জুট মিল
খুলনার দৌলতপুর জুট মিল

খুলনায় সরকারি মালিকানায় বন্ধ পাটকল চালুর দাবি থাকলেও ইজারার পুরোনো পথে করপোরেশন

খুলনা-যশোর অঞ্চলের ৯টিসহ বন্ধ সব রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সরকারি মালিকানায় চালুর দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে নাগরিক ও শ্রমিকদের বেশ কয়েকটি সংগঠন। খুলনার রাজপথে এখনো তারা বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আগের সরকারের মতো বন্ধ কারখানা ইজারার মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোগে চালুর পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)।

খুলনা অঞ্চলের ৯টি পাটকলের মধ্যে ৪টি ইতিমধ্যে বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত ৩০ সেপ্টেম্বর নতুন করে খুলনার স্টার ও প্ল্যাটিনাম জুবিলি জুট মিলসহ সারা দেশের ছয়টি পাটকল ইজারা দিতে আগ্রহীদের থেকে আন্তর্জাতিক আবেদন আহ্বান করেছে বিজেএমসি। ১১ নভেম্বর পর্যন্ত আবেদন জমা দেওয়া যাবে।

২০২০ সালের ১ জুলাই খুলনার ৯টিসহ মোট ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেয় সরকার। কর্মকর্তা-কর্মচারী বাদে এসব কারখানার ৩৩ হাজারের বেশি শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়। খুলনার ৯টি পাটকলের জমির পরিমাণ ৫১৬ একর। এর মধ্যে ২৮৮ একর ইজারা দেওয়া হয়েছে বা ইজারা প্রক্রিয়াধীন।

সম্প্রতি খালিশপুরের ক্রিসেন্ট জুট মিলে গিয়ে দেখা যায়, সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে সুনসান নীরবতা। শ্রমিক কলোনির ভবনগুলোর জীর্ণ দশা। ভবনের দেয়ালে গুল্মজাতীয় গাছ জন্মেছে। জনশূন্যতা ছাড়া গাছগাছালিতে ভরা কলোনির কিছুই বদলায়নি।

কারখানার ফটকে দায়িত্বরত নিরাপত্তারক্ষী মো. মিরাজ আলী বলেন, ‘আমাদের নিজেদের ও মিলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ধারণা নেই। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বড় গ্রুপের কর্মকর্তারা আসেন। আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে আপ্যায়ন করি। কিন্তু ইজারাও হয় না, অন্য কোনো কিছুও হয় না।’

বিজেএমসি সূত্রে জানা গেছে, খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে দৌলতপুর জুট মিলটি ফরচুন গ্রুপের কাছে ইজারা দেওয়া হয়। ফরচুন গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনি ওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যার টেকনোলজি কারখানায় স্বল্প পরিসরে উৎপাদন শুরু করেছে। পাশাপাশি তাঁরা জুতা তৈরির কাজও করছে। গত বছরের নভেম্বরে যশোরের রাজঘাট এলাকার জেজেআই জুট মিলের ইজারা পাওয়া আকিজ গ্রুপ উৎপাদন শুরু করেছে। ইস্টার্ন ও কার্পেটিং মিল দুটি ভারতের রিগ্যাল গ্রুপকে ইজারা দেওয়া হয়েছে। খালিশপুর জুট মিল ইজারা নিতে শর্তানুযায়ী অগ্রিমের টাকা জমা দিয়েছে রেডিয়্যান্ট গ্রুপ। কিন্তু এখনো হস্তান্তর হয়নি। ক্রিসেন্ট জুট মিল ইজারা নিতে ঢাকা শকস নামের একটি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়েছিল। তারা কিছুটা সময় চেয়েছে। আলিম জুট মিলের মালিকানা নিয়ে মামলা চলায় কোনো সিদ্ধান্ত নেই।

ইজারায় চলা দৌলতপুর জুট মিলের শ্রমিক মো. হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখানে পাটের শ্রমিক কম, জুতার সেক্টরে শ্রমিক বেশি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বেতন কম, সংসার চলে না।’

চলতি বছরের ১৮ মে খুলনার চারটি পাটকল পরিদর্শনে এসে আশানুরূপ উৎপাদন না হওয়ায় আক্ষেপ করেছিলেন তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘লিজের শর্ত ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণ পাটজাত পণ্য উৎপাদনসহ মিলের পুরাতন দক্ষ কর্মীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। তা না হওয়ায় এ বিষয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে মন্ত্রণালয়।’

কয়েক বছর ধরে বন্ধ পাটকল চালু, শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধসহ নানা দাবি জানিয়ে আসছেন পাটকল রক্ষায় সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের নেতারা। সংগঠনটির আহ্বায়ক কুদরত-ই-খুদা বলেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের পাট ও বস্ত্র উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সব তথ্য–উপাত্তসহ শ্রমিক-নাগরিকদের ৯ দফা দাবি পেশ করেছিলাম। তিনি আমাদের দাবিদাওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু আবার ইজারার দরপত্র আহ্বান করাটাকে আমরা সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছি। অবশ্যই প্রয়োজনীয় সংস্কার করে পাটকলগুলো রাষ্ট্রের মালিকানায় চালানো উচিত।’

পাওনা টাকা পরিশোধ ও রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল চালু করার দাবিতে শ্রমিকদের মানববন্ধন। ১৫ অক্টোবর খুলনার ক্রিসেন্ট জুট মিলের সামনে

তবে বিজেএমসির খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সমন্বয়কারী গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারিভাবে আবার পাটকল চালুর আলোচনা বাইরের। পাটকলগুলো ইজারা দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত ছিল, তা বহাল আছে।

বন্ধ পাটকলে খরচ ব্যাপক

বন্ধ পাটকলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলেও এখনো বিজেএমসিতে ২ হাজার ৩৪৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের মধ্যে ৮৯৮ জন কর্মকর্তা ও ১ হাজার ৪৪৯ জন কর্মচারী। তাঁদের মধ্যে খুলনা অঞ্চলের বন্ধ পাটকল পরিচালনা ও পাহারার দায়িত্বে আছেন ৯০৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁদের মধ্যে কর্মকর্তা ৩১১ ও কর্মচারী ৫৯২। কাজ না থাকলেও তাঁদের নিয়মিত বেতন–ভাতা দিচ্ছে সরকার। সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় আছে। ফলে এসব খাতে রাষ্ট্রের বড় অঙ্কের অর্থ গচ্চা যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, শুধু বেতন বাবদ বর্তমানে প্রতি মাসে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা। আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ মিলে ৯টি পাটকলে প্রতি মাসে ব্যয় ৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। বন্ধের পর গত ৫০ মাসে খুলনা অঞ্চলের কারখানা পাহারা দিতে তাঁদের বেতন বাবদ প্রায় ১৯১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ সময়ে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ২২৪ কোটি টাকা। বন্ধ মিলে এভাবে বসিয়ে বসিয়ে বেতন–ভাতা দেওয়াকে অযৌক্তিক মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতনের পর ২৭ আগস্ট খুলনার ৯টিসহ রাষ্ট্রীয়ভাবে সব পাটকল চালুর দাবিতে খুলনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের খালিশপুর শিল্পাঞ্চল আঞ্চলিক শাখা। সংগঠনটির আহ্বায়ক আবু দাউদ দ্বীন মোহাম্মদ বলেন, পাটকল বন্ধ করে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা হলেও বিজেএমসির কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তেই আছেন। তাঁরা কোনো কাজ ছাড়াই প্রতি মাসে বেতন পাচ্ছেন। অন্যদিকে কারখানা চালু না থাকায় যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কারখানাগুলো সরকার অন্য প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দিলেও তারা পাটকল চালু না করে অন্য ব্যবসা করার পাঁয়তারা করছে।

সম্মিলিত নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক কুদরত-ই-খুদা প্রথম আলোকে বলেন, পাটকলগুলো লোকসানের মূলে কর্মকর্তাদের অনিয়ম, মাথাভারী প্রশাসন, দুর্নীতি ও পরিকল্পনা না থাকা। হাজার বছরের ঐতিহ্য পাটশিল্পের অতীত গৌরবে ফিরিয়ে আনতে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।