ফুটবল নিয়ে তর্কাতর্কির জের ধরে ছুরিকাঘাতে নিহত সুমনের বাবা বশির আহমদ ও স্বজনদের আহাজারি। গতকাল ফেনীর কাজিরবাগ ইউনিয়নের অশ্বদিয়া গ্রামের রাসেল মিয়ার কলোনিতে
ফুটবল নিয়ে তর্কাতর্কির জের ধরে ছুরিকাঘাতে নিহত সুমনের বাবা বশির আহমদ ও স্বজনদের আহাজারি। গতকাল ফেনীর কাজিরবাগ ইউনিয়নের অশ্বদিয়া গ্রামের রাসেল মিয়ার কলোনিতে

ফেনীতে খুন হওয়া সুমন ছিলেন মা-বাবার শেষ ভরসা

ফেনীতে ফুটবল খেলা নিয়ে তর্কাতর্কির জেরে ছুরিকাঘাতে নিহত সুমন ছিল মা–বাবার শেষ অবলম্বন। তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে বড় দুই ছেলে বিয়ে করে নিজ নিজ স্ত্রী নিয়ে মা–বাবা থেকে পৃথক থাকেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় ১২ বছর আগে। বৃদ্ধ বাবা বশির আহমদ এবং মা বিবি হাজেরার একমাত্র অবলম্বন ছিলেন ছোট ছেলে সুমন। গত শনিবার রাতে সুমন খুন হওয়ার পর তাঁদের সেই অবলম্বনও এখন আর নেই।

গতকাল সোমবার ফেনী সদর উপজেলার কাজিরবাগ ইউনিয়নের অশ্বদিয়া গ্রামের রাসেল মিয়ার কলোনিতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের শোকে বিলাপ করে কাঁদছেন বশির আহমদ। তিনি বলেন, মেঘনার ভাঙনে ৩০ বছর আগে ভিটেবাড়ি হারিয়েছেন। তারপর স্ত্রী, ছোট ছোট দুই ছেলে ও এক মেয়েকে মেঘনার পাড় রামগতি থেকে ফেনীতে চলে আসেন। কখনো ইটভাটায়, কখনো দিনমজুরি, কখনো অন্য কোনো কাজ করেছেন। কোনো কোনো দিন উপোসও থাকতে হয়েছে। বস্তিতে অল্প ভাড়ার ঘরে থাকতে হয়। ছোট ছেলে মো. সুমনের জন্ম হয়েছে ফেনীতে। সে–ই ছিল তাঁদের একমাত্র অবলম্বন। সুমন না থাকায় আবার কষ্টের দিনগুলো ফিরে আসবে বলে আশঙ্কা তাঁর।

১২ বছর ধরে বশির আহমদ ফেনী সদর উপজেলার কাজিরবাগ ইউনিয়নের অশ্বদিয়া গ্রামের রাসেল মিয়ার কলোনিতে দুই হাজার টাকায় দুই কক্ষের একটি বাসায় ভাড়া থাকছেন। একটি কক্ষে বশির ও তাঁর স্ত্রী থাকেন। অপর কক্ষটিতে ছোট ছেলে মো. সুমন থাকত। গত দুই দিন সুমনের কক্ষ কেউ যায়নি। সুমনের বিছানাপত্র এখনো ঠিক আগের মতোই আছে। সেসব দেখিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা বশির আহমদ।

বশির আহমদের স্ত্রী বিবি হাজেরা রোববার বিকেলে ছেলে সুমনের লাশের সঙ্গে লক্ষ্মীপুরের রামগতি গেছেন। সেখানে স্বজনেরা তার লাশ দাফন করেছেন। বিবি হাজেরা কয়েক দিন থেকে ছেলের কবর দেখে তারপর ফিরে আসবেন।

বৃদ্ধ বশির আহমদ বলেন, বড় ছেলে জামালকে টাকাপয়সার অভাবে স্কুলেই পাঠাতে পারেননি। একটু বড় হওয়ার পর থেকে কাজ শুরু করে। মেজ ছেলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। আর তার ছোট ছেলে মো. সুমন নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। বড় দুই ছেলে পিকআপ গাড়ির চালক। তারা দুজন আলাদা বাসা নিয়ে থাকেন। ছোট ছেলে সুমন রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করত। আয় যা হতো তা দিয়েই চলত সংসার। সুমন ছিল মা–বাবার শেষ অবলম্বন।

বশির বলেন, সুমন শনিবার সকালে কাজে যায় ছাগলনাইয়া উপজেলায়। সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরে আসে বাসায় ভাত খায়। এর মধ্যে রাত আটটার দিকে নাঈম নামে তার এক বন্ধু পিকনিকের কথা বলে সুমনকে টেলিফোন করে। সুমন পিকনিকে যেতে অসম্মতি জানায়। তারপর ওষুধ আনার কথা বলে সে স্থানীয় রানীরহাট বাজারে যায়। এরপর রাত ১১টার দিকে হাসপাতাল থেকে ফোন পেয়ে তাঁরা হাসপাতালে ছুটে যান। সেখানে সুমনকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান।

ছেলের সঙ্গে কারও বিরোধ ছিল না বলে দাবি করেন বশির আহমদ। কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, ‘কোনো দিন কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে শুনিনি। তবু কেন তাকে হত্যা করা হলো?’ বৃদ্ধ বশির আহমদ তাঁর শেষ অবলম্বন ছোট ছেলে সুমনের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন।

প্রসঙ্গত, শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফেনী-ছাগলনাইয়া আঞ্চলিক সড়কের ফেনী সদর উপজেলার কাজিরবাগ ইউনিয়নের রানীরহাট এলাকায় ফুটবল খেলা নিয়ে তর্কাতর্কির সময় সুমনকে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। রোববার দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এ হত্যার ঘটনায় সুমনের বড় ভাই জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে তিনজনের নাম উল্লেখ এবং চারজনকে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে আসামি করে ফেনী সদর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। পুলিশ দুই আসামিকে রোববার রাতে গ্রেপ্তার করে।