মাথা ও ঘাড়ব্যথা নিয়ে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন জাহাঙ্গীর হোসেন (৬২)। চিকিৎসক তাঁকে এমআরআই (ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং) করাতে বলেন। হাসপাতালের এমআরআই যন্ত্রটি অচল। তিনি স্থানীয় একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ওই পরীক্ষা করেন।
এমআরআই করতে জাহাঙ্গীর হোসেনের খরচ হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। তবে এই পরীক্ষার জন্য সরকারি হাসপাতালে নির্ধারিত ফি তিন হাজার টাকা।
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমআরআইসহ পরীক্ষা–নিরীক্ষার প্রায় অর্ধেক যন্ত্রপাতিই অচল। চলতি বছরের শুরুতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিমিউ অ্যান্ড টিসি বিভাগে হাসপাতালে অচল-সচল ও মেরামতযোগ্য যন্ত্রপাতির তথ্য পাঠিয়েছে। এতে দেখা যায় ৫৫৫টি যন্ত্রের মধ্যে ২৫৭টি অচল। অচল যন্ত্রের মধ্যে এমআরআই ও সিটি স্ক্যানের মতো বড় যন্ত্র যেমন আছে, তেমনি আছে পালস অক্সিমিটারের মতো ছোট যন্ত্রও।
সম্প্রতি হাসপাতালে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগ ঘুরে দেখা যায়, পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে এমআরআই যন্ত্র। দীর্ঘদিন অচল থাকায় প্রিন্টার, কম্পিউটারসহ অন্য ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশগুলো নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। পাশের কক্ষে সিটি স্ক্যান যন্ত্রটি নষ্ট ছিল প্রায় দুই বছর। সম্প্রতি মেরামত করা হয়েছে। তবে ফিল্ম না থাকায় সিটি স্ক্যান বন্ধ।
এমআরআই যন্ত্রটি পরিচালনা করতেন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং) গোপেশ চন্দ্র সরকার। তিনি জানান, ফিলিপস কোম্পানির এমআরআই যন্ত্রটি লেক্সিকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৩ সালে হাসপাতালে স্থাপন করে। প্রায় তিন বছর ঠিকঠাক চলে। পরে যন্ত্রটির হিলিয়াম লেভেল কমে যায়। কোম্পানি থেকে বেশ কয়েকবার টেকনিশিয়ান এসেছে; কিন্তু মেরামত করতে পারেননি।
হাসপাতালে সপ্তাহের ছয় দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় সকাল ৮টা থেকে বেলা ১টা। হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ রোগীর শয্যার পাশে রাখা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট।
কয়েকজন চিকিৎসক-নার্স জানান, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে কিছু প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাম ছাড়া অন্য কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না। প্রায় ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালের করিডর ও ওয়ার্ডে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিনিধিরা থাকেন। কিছু ওয়ার্ডবয়ের সহযোগিতা নিয়ে রোগীদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যান এই প্রতিনিধিরা। বেসরকারি হাসপাতালে প্রতি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সরকারি হাসপাতালের চেয়ে কমপক্ষে ২০-৪০ শতাংশ অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয় রোগীদের। এ ছাড়া কিছু চিকিৎসকও রয়েছেন, যাঁরা সংশ্লিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দেন রোগীদের।
শয্যাসংকট, ৪৮ শতাংশ চিকিৎসকের পদ শূন্য
হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৫০০। বিপরীতে প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি থাকেন ৯০০ থেকে ১ হাজার ১০০ জন। বহির্বিভাগেও প্রতিদিন সেবা নেন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত সহস্রাধিক শিশু-নারী-পুরুষ। বর্তমানে চিকিৎসক ও ওষুধসংকট, নষ্ট যন্ত্রপাতি, দালালদের দৌরাত্ম্য, আউটসোর্সিং নিয়োগ ও দায়িত্ব পালনকারীদের বিষয়ে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে পুরো হাসপাতালটিই যেন রোগী হয়ে গেছে।
১৯৯২ সালে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের যাত্রা শুরু। পরে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ হলে ২০০৬ সালে শুরু হয় স্বাস্থ্যসেবা। এরপর সময় পেরিয়েছে প্রায় দেড় যুগ। দীর্ঘ সময়ে হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা উন্নতির বদলে ক্রমে অবনতি হয়েছে। রোগীদের অসন্তোষ ও ভোগান্তি বেড়েছে। হাসপাতালের সীমাবদ্ধতার এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন রোগী ও তাঁর স্বজনেরা।
সম্প্রতি হাসপাতালে আইসিইউতে শয্যা না পাওয়ায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার হয় হবিবর রহমানের (৫২)। তাঁর খরচ হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। হবিবর রহমানের বাড়ি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আমবাড়ি এলাকায়।
হবিবরের ছেলে রিয়াজ হোসেন (২০) বলেন, ‘রাতে বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আড়াইটায় বাবাকে হাসপাতালে আনি। ইন্টার্ন চিকিৎসক সিটি স্ক্যান করার পরামর্শ দেন। কিন্তু হাসপাতালের মেশিন নষ্ট। বাইরে থেকে করাতে হয়েছে। পরে আইসিইউতেও বেড না পেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশন করাই। দুই দিন পরে বেড ফাঁকা পেয়ে বাবাকে আবারও সরকারি হাসপাতালে আনি। এখানে শুধু গ্যাসের ওষুধ আর একটা অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন পেয়েছি। বাকি সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। ট্রলি দিয়ে তৃতীয় তলায় বাবাকে নেওয়ার সময়ও প্রতিবার ১০০ টাকা দিতে হয়েছে ওয়ার্ড বয়দের।’
হাসপাতালের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী এখানে চিকিৎসকদের অনুমোদিত পদ ২১২টি। সেখানে কর্মরত আছেন ১১১ জন। হিসাব অনুযায়ী ৪৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ চিকিৎসকের পদ শূন্য। এর মধ্যে সিনিয়র কনসালট্যান্ট ১২ জনের স্থলে ৫ জন, জুনিয়র কনসালট্যান্ট ৮ জনের স্থলে ৩ জন, আবাসিক সার্জন ১৩ জনের স্থলে ৯ জন, বিভিন্ন বিষয়ে রেজিস্ট্রার ও সহকারী রেজিস্ট্রার চিকিৎসক ৭০ জনের স্থলে ৩১ জন এবং অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ১৫ পদের বিপরীতে আছেন মাত্র একজন। তবে মেডিকেল অফিসার ৫০ পদের বিপরীতে ৪৩ জন কর্মরত। এ ছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির ১৩৩ পদের বিপরীতে ৬৫টি পদ শূন্য রয়েছে।
শিশু ওয়ার্ডের চিকিৎসক সেখ সাদেক আলী খান বলেন, ‘এই ওয়ার্ডে নির্ধারিত বেড সংখ্যা ৩৯। কোনো দিন ১৪০ জন পর্যন্ত রোগী থাকে। এ ছাড়া রোগীর সঙ্গে অন্তত দুজন স্বজন থাকেন। শিশু ওয়ার্ডে ৮ জন চিকিৎসক আছেন। যেখানে কমপক্ষে ১৫ জনের দরকার। শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে। তাই স্পর্শকাতর ওয়ার্ডটির জন্য পর্যাপ্ত জায়গাও প্রয়োজন।’
হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ নিউরোসার্জারি। এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল হলেও উত্তরাঞ্চলের মানুষদের ভরসার স্থল হয়েছিল এই হাসপাতাল। নিউরোসার্জারি রোগীদের পৃথক ওয়ার্ড না থাকায় হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় সাধারণ সার্জারি ওয়ার্ডেই রাখা হয়েছে রোগীদের। প্রতিদিন গড়ে নিউরোসার্জারি রোগী ভর্তি থাকেন ২০-২৫ জন।
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে হাসপাতালে চালু হয় নিউরোসার্জারি অস্ত্রোপচার। গত বুধবার পর্যন্ত হাসপাতালে প্রায় ৮০০ নিউরোসার্জারি রোগীর অস্ত্রোপচার হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে একজন চিকিৎসক দিয়েই চলছে নিউরোসার্জারি বিভাগ। একমাত্র নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞ সারোয়ার মোর্শেদ আলম বলেন, সপ্তাহে দুই দিন অস্ত্রোপচার করা হয়। শুরু থেকে একজন চিকিৎসক দিয়েই চলছে বিভাগটি। এ ক্ষেত্রে সার্জারি ওয়ার্ডের চিকিৎসক ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সহায়তা নিয়ে চালাচ্ছি। এরই মধ্যে কোমরের হাড়ের অস্ত্রোপচারের গুরুত্বপূর্ণ সি-আর্ম মেশিনটিসহ কয়েকটি মেশিন বিকল হয়ে আছে। ফলে কিছু রোগীকে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে।
২৩৬ জনের বেতন ভাগ হয় ৩৮৮ জন আউটসোর্সিং কর্মীর মধ্যে
সম্প্রতি মাথায় আঘাতজনিত সমস্যায় মামাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন এমদাদুল হক। চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েছেন। সার্জারি ওয়ার্ডের করিডরে কথা হয় এমদাদুলের সঙ্গে। মামাকে হাসপাতালের বাইরে নিতে ট্রলি ও ওয়ার্ডবয় খুঁজছেন তিনি। কিছুক্ষণ পর একজন হাজির হলেন এবং কথা বললেন এমদাদুলের সঙ্গে। পরে জানা যায় ১০০ টাকার বিনিময়ে ট্রলিতে নিচতলায় নামিয়ে দিয়েছেন ওই ব্যক্তি।
জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে নেওয়া, ওয়ার্ড থেকে হাসপাতালের বাইরে আনাসহ ছোটখাটো প্রায় সব কাজেই আউটসোর্সিং কর্মচারীদের টাকা দিলে সেবা মেলে রোগীদের। তাঁদের বিরুদ্ধে হাসপাতালে আসা রোগীদের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে পাঠিয়ে সেখান থেকে কমিশন গ্রহণ করার অভিযোগও রয়েছে। হাসপাতালের ওষুধ-স্যালাইন এমনকি ফ্যান চুরির ঘটনা আছে। গত মে মাসে হাসপাতালে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ২২ জন দালালকে আটক করে জেলহাজতে দিয়েছিল।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে আউটসোর্সিং কর্মচারী রয়েছেন ৩৮৮ জন। যদিও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন আছে ৫ ক্যাটাগরিতে ২৩৬ জনের। তাঁদের বেতন ধরা হয়েছে মাসে সাড়ে ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার। গালফ সিকিউরিটি সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড মাসিক দেড় লাখ টাকা কমিশনে এই জনবল সরবরাহ করে। ২০১৯ সালে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আউটসোর্সিংয়ে ১৫২ জনকে অতিরিক্ত নিয়োগ দেয়। ২৩৬ জনের বেতন ৩৮৮ জনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে।
৯–১৬ অক্টোবর খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত অন্তত ২৫ জনের খোঁজ মেলেনি। নিচতলায় আউটসোর্সিং অফিসে হাজিরা খাতায়ও স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি অনেকের। আউটসোর্সিংয়ে কর্মরতদের দেখভাল, বেতনাদি পরিশোধসহ যাবতীয় কাজ করেন হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার মাসুদ রানা ও ফারুকুল আলম মামুন। তাঁদের কাছে অতিরিক্ত ১৫২ জনের তালিকা দেখতে চাইলে নানা টালবাহানায় তাঁরা তথ্য দেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আউটসোর্সিং কর্মী বলেন, আউটসোর্সিংয়ের কর্মীদের অনেকের স্বজন হাসপাতালে বড় পদে চাকরি করেন। এমন অনেকে আছেন, মাসের এক দিনও হাসপাতালে আসেন না; মাস শেষে শুধু বেতন তোলেন। হাসপাতালের টয়লেট থেকে শুরু করে করিডরের আশপাশ নোংরা থাকে। দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত কুকুর চলে আসে।
অপর একজন বলেন, ‘প্রতি মাসে ব্যাংক থেকে মেসেজ পাই ১৬ হাজার ১৭৭ টাকার। ওয়ার্ড মাস্টার বেতন দেন ৯ হাজার ২০০ টাকা। ২৩৬ জনের ব্যাংকের চেকবইগুলো স্বাক্ষর করে ওয়ার্ড মাস্টার নিয়ে রেখেছেন। বর্তমান যুগে ৯ হাজার ২০০ টাকায় সংসার চলে না। বাধ্য হয়েই হাসপাতালে অনৈতিকভাবে আয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন আউটসোর্সিং কর্মচারীরা।’
এসব বিষয়ে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এ টি এম নুরুজ্জামান বলেন, ‘সারা দেশে প্রান্তিক হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক–সংকট আছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয় জানে। হাসপাতালের এমআরআই যন্ত্রটি পুরোপুরি অচল। সম্প্রতি সিটি স্ক্যান যন্ত্রটি মেরামত করা হয়েছে। অচল যন্ত্রপাতির তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এ টি এম নুরুজ্জামান আরও বলেন, হাসপাতালে নির্ধারিত শয্যার চেয়ে দ্বিগুণ রোগী থাকে। হাসপাতালের চতুর্থ তলা সম্প্রসারণের কাজ চলছে। মেয়াদ শেষ হলেও গণপূর্ত বিভাগ হস্তান্তর করতে পারেনি। সেটি চালু হলে শয্যাসংকট কেটে যাবে। আউটসোর্সিং কর্মচারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাঁদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’