খুলনার কয়রা উপজেলা সদর থেকে সুন্দরবনঘেঁষা সুতিয়া বাজারে যাওয়ার সময় সড়কের পাশেই ঝুপড়িটি চোখে পড়ে। গোলপাতা, তালপাতা ও পলিথিনে মোড়ানো ভাঙাচোরা সেই ঝুপড়িতে বসবাস করেন ইছামতী বেগম (৬০)। তাঁর স্বামী মারা গেছেন প্রায় ৩০ বছর আগে। তাঁর কোনো সন্তান নেই। মানুষের বাড়িতে কাজ করে ও অন্যের দান-দক্ষিণায় যা পান, তা দিয়ে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে বেঁচে আছেন তিনি।
রোববার সকালে কয়রা সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর কয়রা গ্রামের সড়কের পাশে ঝুপড়ির কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলে ইছামতী বেগম বললেন, ‘কী বুলতিছেন বাপু, কানে তো শুনিনে, একটু জোরে কন।’ বোঝা গেল, বয়সের তুলনায় শরীর একটু বেশি ভেঙে পড়েছে। কানেও কম শোনেন।
ঝুপড়িটির পাশে সম্প্রতি সরকারি অর্থে নতুন একটি পাকা শৌচাগার নির্মিত হয়েছে। সেই শৌচাগারের দিকে হাত ইশারা করে ইছামতী বললেন, ‘কদিন আগে পাকা টয়লেট বানাইদিছে সাহেবেরা। তবে ভাঙা ঘরে থাকি, আমি আর আমার পাগল ভাই মোজাফফর গাজী। ভাইয়ের মৃগীরোগ আছে, তার বউ-ছেলেমেয়ে নাই। পাগল বলে কেউ কাজকর্মেও নেয় না। আমি এই বয়সে মানুষের বাড়িতে কাজকাম করে যা আনি, তাই দুজনে খাই। এর মধ্যে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ছি, ওষুধ কিইন্যা খাওয়া লাগে। কয়েক মাস পরপর সরকারিভাবে বয়স্ক ভাতার ১ হাজার ৫০০ করে টাকা পাই। আপনারা আইছেন, খুশি হইছি। এইবার একখান থাকার ঘরের ব্যবস্থা করি দেন।’
ঝুপড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়রা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী ইস্তিয়াক আহমেদ। তিনি এসেছিলেন ইছামতীর পাকা শৌচাগার দেখতে। প্রকৌশলী ইস্তিয়াক আহমেদ বলেন, রাস্তার পাশে প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে ঘেরা ঝুলন্ত টয়লেট ছিল ইছামতী বেগমের। একদিন এই পথে যাওয়ার সময় সেই দৃশ্য দেখে তাঁর দপ্তর থেকে পাকা শৌচাগারটি নির্মাণ করে দিয়েছেন। মানুষটাকে ভালো রাখতে একটা বসতঘরও নির্মাণ করে দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তাঁর দপ্তরে তো ঘরের বরাদ্দ হয় না।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, বহু বছর ধরে ঝুপড়িতে বসবাস করছেন ইছামতী। তাঁর স্বামী মাজেদ সরদার মারা যাওয়ার পর পড়েন বিপাকে। এখন বৃদ্ধ বয়সে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এক ভাইকে সঙ্গে নিয়ে থাকেন তিনি। পরিবারের অন্য কোনো সদস্য না থাকায় ইছামতীর কষ্ট আরও বেড়েছে। আশপাশের বাসাবাড়িতে কাজ করে যা পান, তাই দিয়েই সংসার চলে। যেদিন কাজ করতে পারেন না, সেদিন অনাহারে–অর্ধাহারে থাকতে হয় দুই ভাই–বোনকে।
৪ নম্বর কয়রা গ্রামের অধিকাংশ মানুষ সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। দুর্মূল্যের বাজারে তাঁদেরও টানাটানির মধ্যে দিন কাটছে বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মন চাইলেও আমরা সব সময় অসহায় ইছামতীকে সহযোগিতা করতে পারি না।’
বৃষ্টি হলে বিছানার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে রাত কাটান ইছামতী। আর বৃষ্টির পানিতে ঘরের সবকিছু ভিজে যায়। এখন কনকনে ঠান্ডা বাতাস তাঁর ঝুপড়িতে ঢোকে। শীতবস্ত্রের অভাবে আছেন কষ্টে। প্রচণ্ড শীতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করতে তাঁকে। ইছামতী বলেন, ‘দুনিয়ায় আমার কেউ নেই। বয়স হইছে, শরীরেও বল পাইনে, আগের মতো কাজও করতি পারিনে। শুনিছি, সরকার গরিব মানষির অনেক কিছু দেয়। কই, আমি তো তেমন কিছু পাইনে। সবার ঘর আছে, কারেন্টের আলো জ্বলে, আর আমার ঝুপড়িতে এখনো পুরোনো কেরোসিন তেলের কুপি। দুবেলা দুমুঠো ভাতও খাতি পারিনে। শেষ জীবনে একখান ঘর পাই কি না, সেই জন্য জনপ্রতিনিধিদের কাছে বহুবার গেছি। সবাই খালি আশ্বাস দেয়, কেউ ঘর দেয় না।’
প্রতিবেশী রহিমা খাতুন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অসহায় মানুষটি (ইছামতী) বাড়ি বাড়ি কাজ করে চাল-ডাল সংগ্রহ করে দিনযাপন করেন। পাড়া-প্রতিবেশীদের দেওয়া দুমুঠো খাবারেই ক্ষুধা নিবারণ করেন। মাঝেমধ্যে চাল-ডাল যা পারেন, দেন। সরকারি কিংবা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাঁর পাশে দাঁড়ালে তিনি শেষ জীবনটা ভালোভাবে কাটাতে পারবেন।
কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. লুৎফর রহমান মুঠোফোনে বলেন, ‘ইছামতী বেগমকে আমিও চিনি। বৃদ্ধ মহিলা তাঁর ভাইকে নিয়ে থাকেন। ঝুপড়িতে বৃষ্টি-বাদল আর শীতের দিনে খুব কষ্ট হয় তাঁদের। কয়েক দিন আগে সরকারিভাবে একটি শৌচাগার নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই একটা ঘর নির্মাণ করে দিতে আমরা চেষ্টা করছি।’