বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত হন মাহবুব আলম
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত হন মাহবুব আলম

মাহবুবের আইটি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন মিশে গেছে রাজপথে

‘আমার ছেলে মাহবুবের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া কইরা বড় আইটি উদ্যোক্তা হইব। সংসারের অভাব-অনটন দূর করব। কিন্তু ওর সেই স্বপ্ন পূরণ হইল না। আমি শুনছি, আন্দোলন করতে গিয়া প্রশাসনের গাড়ির তলে পইড়া ও মইরা গেল। আর আমার ছেলের স্বপ্ন রাজপথে মিশে গেল। যারা আমার ছেলেরে মারছে, আমি তাদের বিচার ও শাস্তি চাই।’

শেরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘাতে নিহত মাহবুব আলমের মা মাহফুজা খানম কান্নাজড়িত কণ্ঠে গতকাল শুক্রবার বিকেলে প্রথম আলোর কাছে এ কথাগুলো বলেন। মাহবুব আলম (২০) সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়নের চৈতনখিলা বটতলা গ্রামের মো. মিরাজ আলীর ছেলে। তিনি শেরপুর সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। আইটি ল্যাব এডুকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।

৪ আগস্ট বিকেলে শেরপুর শহরের খরমপুর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিল চলাকালে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্রুতগতির গাড়ির চাপায় মাহবুব আলম নিহত হন। ওই দিন গাড়ি চাপা ও গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনসহ পাঁচজন নিহত হন।

নিহত অন্য চারজন হলেন, শেরপুর শহরের বাগরাকসা এলাকার বাসিন্দা ও আহ্ছানউল্লা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তুষার আহমেদ, ঝিনাইগাতী উপজেলার পাইকুড়া গ্রামের শারদুল আশিস, শ্রীবরদী উপজেলার রূপারপাড়া গ্রামের সবুজ হাসান ও সদর উপজেলার ভীমগঞ্জ এলাকার মীম আক্তার। তাঁরা শিক্ষার্থী ছিলেন।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত মাহবুব আলমের ছবি হাতে শোকাহত মা–বাবা। শুক্রবার বিকেলে শেরপুর সদর উপজেলার চৈতনখিলা বটতলা গ্রামের বাড়িতে

মাহবুব আলমের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, চৈতনখিলা বটতলা গ্রামের দরিদ্র মিরাজ আলীর দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে মাহবুব ছিলেন চতুর্থ। মাহবুবের বড় দুই বোন মিলিনা ও সেলিনার বিয়ে হয়েছে। বড় ভাই মাজহারুল ইসলাম শেরপুর সরকারি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। আর ছোট বোন মারিয়া চলতি বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। ছোটবেলা থেকেই মাহবুবের তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণ ছিল। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ালেখা করার সময় প্রতিষ্ঠা করেন আইটি ল্যাব নামের কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার।

মাহবুবের বাবা মিরাজ আলী ১৭ থেকে ১৮ বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন। তাঁর মা মাহফুজা গৃহিণী। চৈতনখিলা বটতলা গ্রামে ৮ শতক জমির বসতভিটা ছাড়া মাহবুবের বাবার কোনো ফসলি জমি নেই। তাই মাহবুবকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আন্দোলনে নিহত হয়ে স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।

শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে সদর উপজেলার চৈতনখিলা বটতলা গ্রামের বাড়িতে দেখা যায়, মুঠোফোনে ছেলে মাহবুবের ছবি দেখে মা মাহফুজা কাঁদছিলেন। এ সময় স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। অর্থাভাবে কাঁচা ভিটির ওপর নির্মিত মাহবুবদের টিনের বসত ও রান্নাঘরটি জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। নতুন একটি ঘর তৈরি করার জন্য মাহবুব কয়েক দিন আগে হাজারখানেক ইট কিনেছিলেন। সেগুলো বাড়ির ভেতরে জড়ো করে রাখা হয়েছে।

মাহফুজা খাতুন বলেন, মাহবুব মানুষকে কম্পিউটারের বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং দিয়ে যে টাকা আয় করত, তা নিজের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ মেটাত। সংসারের অন্যতম উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তাঁর পরিবারে নেমে এসেছে অন্ধকার। মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে এখন কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই মাহবুব কঠিন সংগ্রাম করে বড় হচ্ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি ছাত্র পড়িয়ে ও আইটি ল্যাবে কাজ করে সংসারের খরচ জোগাতেন। তাঁর অকালমৃত্যুতে পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে।