প্রবেশনে মুক্ত এক যুবক বললেন, ‘এখন বুঝি, জীবন কত সুন্দর’

প্রবেশন কনফারেন্সে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ কে এম রাশেদুজ্জামান রাজা। শনিবার দুপুরে বরিশাল জেলা জজ আদালতের সম্মেলন কক্ষে
ছবি: প্রথম আলো

‘আদালতের দেওয়া নির্দেশ যথাযথভাবে মেনে চলছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের আর কোনো অপরাধে জড়াব না। আমার বাবা খুবই অসুস্থ। তাঁকে দেখভাল করছি, এতে তিনি ভীষণ খুশি, আমিও নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছি। এখন বুঝি, জীবন কত সুন্দর।’ প্রবেশনে মুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে গতকাল শনিবার দুপুরে বরিশাল জেলা জজ আদালতের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত প্রবেশন কনফারেন্সে এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন এক যুবক।

৩২ বছর বয়সী ওই যুবকের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায়। অনুষ্ঠানে ওই যুবক আরও বলেন, ‘আমি মাদক মামলায় দুই বছরের কারাদণ্ডের শাস্তি পেয়েছিলাম। এরপর বাবার সেবা করার শর্তে আমি প্রবেশন লাভ করি। শয্যাশায়ী বাবার সেবার পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে পরিবারের হাল ধরেছি। এখন বুঝি, কতটা অন্ধকারে ছিলাম আমি। এটা আমার কাছে নতুন জন্মের মতো লাগে।’

মাদক আইনের অপর একটি মামলায় বরিশালের বাবুগঞ্জের এক ব্যক্তির দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। প্রবেশনের শর্ত হিসেবে তাঁকে সমাজের অবহেলিত মানুষের সেবা করার শর্ত দেওয়া হয়। শর্ত পূরণ করে মুক্ত হওয়ার পর তিনি স্থানীয় একটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিয়ে সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচিত ওই ইউপি সদস্য প্রবেশন কনফারেন্সে বলেন, সামাজিক কাজ করতে গিয়ে তিনি মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। এরপর তাঁরাই তাঁকে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছেন। নির্বাচনের ব্যয়ও করেছেন ভোটাররা। তিনি আত্মবিশ্বাসী, ভবিষ্যতে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং জয়ী হবেন।

গত চার বছরে মাদক সেবন, মারামারিসহ লঘু অপরাধে সাজা পাওয়া বরিশাল জেলার ২০২ জন এবং বরিশাল নগরের ৯২০ জন আদালতের নির্দেশে প্রবেশনে মুক্তি পেয়ে মা-বাবার সেবা, বৃক্ষরোপণসহ নানা ভালো কাজ করে নিজেদের সংশোধনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ৭০ জন এরই মধ্যে আদালতের শর্ত পূরণ করায় দণ্ড থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে ফিরেছেন স্বাভাবিক জীবনে। অন্যরাও ফেরার অপেক্ষায়। ওই যুবক ৭০ জনের মধ্যে একজন।

প্রবেশনে থাকা ব্যক্তিদের জীবনমান ও নতুন জীবনে তাঁরা কীভাবে কাজ করছেন, সে বিষয়ে অভিব্যক্তি জানার আগ্রহ দেখান বিচারকেরা। তাঁদের আগ্রহের ফলে গতকাল বরিশাল জেলা জজ আদালতের সম্মেলনকক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল প্রবেশন কনফারেন্সের। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বরিশাল জেলা জজ কে এম রাশেদুজ্জামান রাজা, বিশেষ অতিথি ছিলেন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিজিএম) আশরাফুল আলম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ফয়েজুল হক, সাধারণ সম্পাদক দেলায়ার হোসেন, জেলা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ওবায়দুল্লাহ, সমাজসেবা অধিদপ্তরের বরিশাল জেলার উপপরিচালক এ কে এম আক্তারুজ্জামান তালুকদার, জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ, মহানগর প্রবেশন কর্মকর্তা শ্যামল কুমার দত্ত প্রমুখ।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিজিএম) আশরাফুল আলম বলেন, ‘প্রবেশন দেওয়ার চর্চা যে বরিশালে রয়েছে, সেটা সবাইকে জানাতে হবে। তাহলে সারা দেশে এর চর্চা বাড়বে। কারণ, আমাদের সমাজকে কলুষমুক্ত করার ক্ষেত্রে প্রবেশন আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।’

প্রবেশন আইনের সৃষ্টি এবং এর পরিপ্রেক্ষিত উল্লেখ করে আশরাফুল আলম বলেন, ‘ভালো-মন্দ নিয়েই তো আমাদের সমাজ। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব রয়েছে মন্দদের আইনের মাধ্যমে সুপথে নিয়ে আসা। ছোট ছোট অপরাধে দণ্ডিতরা প্রবেশন পেলে তাঁরাও সমাজের মূল স্রোতে ফিরে পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য সম্পদে পরিণত হতে পারেন। এ জন্য আইনটির সর্বোত্তম ব্যবহারে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। বেশি বেশি প্রচার করতে হবে।’

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি কে এম রাশেদুজ্জামান রাজা বলেন, প্রবেশনে যাঁরা থাকেন, তাঁদের মনে করিয়ে দিতে হবে তাঁরা সাজা পেয়েছেন। কিন্তু ভালো কাজের শর্তে প্রবেশনে থাকবেন। এটা নিশ্চিত করতে হবে বিচারক, আইনজীবী ও প্রবেশন কর্মকর্তাদের। প্রবেশন পেলে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির ব্যয় কমে যায়। কারণ তাঁকে আদালতে হাজির হতে হয় না, আইনজীবীদের ফি দিতে হয় না। এটা আরও কমানো যায়, যদি মামলার অভিযোগ গঠনের সময় আসামিকে বলা হয়, আপনি অপরাধ করেছেন, তা স্বীকার করলে সাজা কম হবে এবং প্রবেশন পাবেন। এটা করা গেলে মামলার ব্যয় আরও কমে যাবে। কিন্তু এ জন্য আইন করতে হবে। সরকার যেহেতু জনকল্যাণে কাজ করছে, তাই এ ব্যাপারে বিষয়টি যথাযথভাবে সরকারের সামনে উত্থাপন করা গেলে অবশ্যই সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।

প্রবেশনপ্রাপ্যরা বিদেশে যেতে পারবেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কে এম রাশেদুজ্জামান রাজা বলেন, প্রবেশন আইনে কিন্তু প্রবেশনারদের চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করার একটি ধারা রয়েছে। তবে এতে কিন্তু বলা হয়নি, এটা দেশে না বিদেশে। সে ক্ষেত্রে প্রবেশন কর্মকর্তা আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে এটার অনুমতি দিতে পারেন। তবে প্রবেশনারদের মাথায় রাখতে হবে, তিনি আদালতের শর্তে তাঁর সাজা স্থগিতাদেশ রয়েছে। তাই প্রবেশনের সময় যথাযথভাবে শর্তপূরণ করতে পারলে, কেবল তিনিই সাজা মাফ পাবেন।