ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে সড়ক উন্নয়নকাজে এভাবে দুই পাশের ফসলের খেত থেকে মাটি কাটা হয়েছে। গতকাল উপজেলার তালিনা গ্রামের মাঠে
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে সড়ক উন্নয়নকাজে এভাবে দুই পাশের ফসলের খেত থেকে মাটি কাটা হয়েছে। গতকাল উপজেলার তালিনা গ্রামের মাঠে

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর

মাটি কাটতে গাছ–ফসল নষ্ট

ঠিকাদারের লোকজন জোর করেই এক্সকাভেটর মেশিন দিয়ে মাটি কেটেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা।

সড়ক উন্নয়নকাজে মাটির প্রয়োজন। তাই পাশের জমিতে থাকা নানা প্রজাতির শত শত গাছ নির্বিচারে কেটে মাটি নেওয়া হয়েছে। বিনষ্ট করা হয়েছে কৃষকের ধান, গম, ভুট্টাসহ মূল্যবান সব ফসল। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার কোটচাঁদপুর-গান্না ভায়া তালিনা সড়কের নির্মাণকাজে এ ঘটনা ঘটেছে। ঠিকাদারের লোকজন সড়কের দুই পাশ বাঁধতে এভাবে গাছ-ফসলের ক্ষতি করে জোর করেই এক্সকাভেটর মেশিন দিয়ে মাটি কেটেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা।

কৃষকেরা বলছেন, এলাকার সড়ক উন্নয়নে তাঁরাও সহযোগিতা করতে চান। মাত্র কয়েকটি দিন অপেক্ষা করলে তাঁদের জমির ফসল কাটা হয়ে যেত। তখন তাঁদের জমি থেকে মাটি নিলে তাঁদের কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু সবুজ ধানগাছ, গম আর বড় বড় গাছ কেটে মাটি নেওয়া হলো। তাঁরা বলেছিলেন, একটু অপেক্ষা করতে। কিন্তু ঠিকাদারের লোকজন কোনো কথা শোনেননি। এখন তাঁরা ক্ষতিপূরণ চান।

কৃষকদের অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ বললেন, মাটি কাটার কারণে কৃষকের ক্ষয়ক্ষতির খবর পেয়েই তাঁরা কাজটি আপাতত বন্ধ করে দিয়েছেন।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পল্লি সড়ক অবকাঠামো পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় এলজিইডি কোটচাঁদপুর-গান্না ভায়া তালিনা সড়ক মেরামতের উদ্যোগ নেয়। তিন কিলোমিটারের সামান্য বেশি এই সড়ক মেরামতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ কোটি ৫৭ লাখ ৭৮ হাজার ৯২৬ টাকা। দরপত্র গ্রহণ শেষে ২ কোটি ৩২ লাখ ১ হাজার ৩৩ টাকায় কাজটি পায় রাজশাহীর সাহেববাজার এলাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বরেন্দ্র কনস্ট্রাকশন। তবে তাদের হয়ে কাজটি করছে ঝিনাইদহের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজী মাহবুবুর রহমান কনস্ট্রাকশন। ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বর শেষ করার কথা। ঠিকাদার চলতি ১ মার্চ থেকে কাজ শুরু করেছেন।

কৃষকের ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, এমন খবর পেয়ে তাঁরা মাটি কাটা আপাতত বন্ধ রাখতে ঠিকাদারকে বলেছেন। ঠিকাদারও বন্ধ রেখেছেন।
আবুল কালাম আজাদ, ভারপ্রাপ্ত উপজেলা প্রকৌশলী, কোটচাঁদপুর

স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, কাজ শুরু করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়কের দুই পাশে মাটি ফেলেছে। এখনো ওই সড়কে কাজের জন্য ইট, বালু না এলেও সড়কের পাশে কৃষকের খেত থেকে এক্সকাভেটর মেশিন দিয়ে মাটি তুলছে।

সরেজমিনে এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। দেখা যায়, সড়কটির দুই পাশে এক্সকাভেটর মেশিন দিয়ে গর্ত খুঁড়ে মাটি তোলা হয়েছে। ফসলি জমি থেকে মাটি তুলে সড়কের দুই পাশে ফেলা হয়েছে। কেটে ফেলা হয়েছে মেহগনি, কড়ই, নিম, খেজুরসহ নানা প্রজাতির শত শত গাছ। নষ্ট করা হয়েছে ধান, গম, ভুট্টাসহ নানা ফসল। কৃষকেরা বলছেন, যেভাবে গর্ত খোঁড়া হয়েছে, তাতে এবার তাঁদের জমি ভাঙতে শুরু করবে। বর্ষা মৌসুমে সমতল জমি ভেঙে গর্তে পড়বে।

স্থানীয় তালিনা গ্রামের কৃষক সব্দুল হোসেন জানান, তাঁর এক বিঘা জমি রয়েছে ওই সড়কের ধারে। ঠিকাদার মাটি কাটতে গিয়ে তাঁর কমপক্ষে ৫০টি খেজুরগাছ কেটে ফেলেছেন। গাছ কাটার সময় প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ঠিকাদারের লোকজন কথা শোনেননি। জোর করেই তাঁর এই ক্ষতি করা হয়েছে।

আরেক কৃষক মতিয়ার রহমান জানান, তাঁর জমির ধানগাছ নষ্ট করে মাটি নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যাঁরা মেশিন দিয়ে মাটি কাটছিলেন, তাঁদের অনুরোধ করেন কয়েকটি দিন অপেক্ষা করতে। তাহলে তাঁর খেতের ধান কাটা হয়ে যাবে, তখন মাটি নিলে এতটা ক্ষতি হবে না। কিন্তু তাঁরা কোনো কথাই শোনেননি।

কৃষক আনোয়ার হোসেন জানান, তাঁর বাবলা, মেহগনিগাছ কাটা হয়েছে। সড়কের কাজ শুরুর আগেই কৃষকদের এই ক্ষতি মানা যায় না। তিনি ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।

তালিনা গ্রামের শান্তি সরদার জানান, তাঁর মাত্র ১০ কাঠা জমিতে ভুট্টার আবাদ ছিল। মাটি কাটা লোকজন অর্ধেক জমির কাঁচা ভুট্টার গাছ কেটে ফেলেছেন। তাঁর বেশ কয়েকটি কড়ইসহ অন্যান্য গাছও কাটা পড়েছে। তিনি আরও বলেন, এক্সকাভেটর দিয়ে না কেটে কোদাল দিয়ে মাটি কাটলে তাঁদের এত ক্ষতি হতো না। গাছপালাও বিনষ্ট হতো না।

তবে কাজী মাহবুবুর রহমান কনস্ট্রাকশনের মালিক ঠিকাদার মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘দরপত্র অনুযায়ী সড়কের পাশ থেকে মাটি কেটে দেওয়ার কথা। আমরা সেটাই করছি। আর ওই কাজ করতে গিয়ে সড়কের কিছু গাছ কাটতে হয়েছে, তা না হলে এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কাটা সম্ভব হচ্ছিল না। আর গাছ কাটার সময় অফিসের সুপার, এসও ও কার্যসহকারী সবাই উপস্থিত ছিলেন।’

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কোটচাঁদপুর উপজেলা প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকা আবুল কালাম আজাদ বলেন, দরপত্রে মাটি বহনের কোনো বরাদ্দ নেই। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদার সড়কের পাশ থেকেই মাটি সংগ্রহ করে থাকেন। এখানেও সেভাবে শুরু হয়েছিল। তবে কৃষকের ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, এমন খবর পেয়ে তাঁরা মাটি কাটা আপাতত বন্ধ রাখতে ঠিকাদারকে বলেছেন। ঠিকাদারও বন্ধ রেখেছেন।