ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বরিশাল নগরের নিম্নাঞ্চলসহ বিভাগের বিভিন্ন জেলার অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ কারণে পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন অনেক মানুষ। আজ সোমবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় এ প্রতিবেদন হালনাগাদ করা পর্যন্ত বরিশালের বিভিন্ন স্থানে প্রচণ্ড ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টিপাত চলছিল। রোববার দিবাগত গভীর রাত থেকে এ অবস্থা বিরাজ করছে।
পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা সদরের বাসিন্দা ছানাউল্লাহ (৩৮) ভোররাত সাড়ে চারটায় প্রথম আলোকে বলেন, সেখানে ভোররাত ৪টা থেকে প্রচণ্ড বাতাস ও বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পাশাপাশি সবার ঘরের নিচতলায় খাল ও নদীর পানি প্রবেশ করেছে। তিনি জানান, তিনি এর এর আগে কখনো এই এলাকায় এ ধরনের বন্যার পানি দেখেননি।
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মুখারবান্দা এলাকার বাসিন্দা মো. মহসিন ভোর পাঁচটায় প্রথম আলোকে বলেন, সেখানে দমকা হাওয়ার সঙ্গে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। এর মধ্যে রোববার বিকেল পর্যন্ত ভোলায় ২৩ হাজার ২৬২ জনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান। বরগুনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, সেখানে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত ২৪ হাজার ৬২৮ জন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। বরিশাল জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা রণজিৎ কুমার জানান, বরিশাল জেলায় ৫৪১ টি আশ্রয় কেন্দ্রে বিকেল পর্যন্ত আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা ৯ হাজার ২৩৩। তবে রাত বাড়ার সঙ্গে এসব স্থানে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সরেজমিনে রোববার সন্ধ্যার পর দেখা যায়, বরিশাল নগরের রূপাতলীর জিয়ানগর, খ্রিষ্টানপাড়া, পলাশপুর, বেলতলা, মোহাম্মদপুর, রসুলপুর, দক্ষিণ রূপাতলী, ভাটিখানা, কাউনিয়া, প্যারারা রোড, সদর রোড, কেডিসি, ত্রিশ গোডাউন, দপদপিয়া, কালিজিরা এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দাদের ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় তারা ঘরবন্দী রয়েছে। এসব এলাকার গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সড়ক চলে গেছে পানির নিচে।
বরিশাল নগরীর রসুলপুরের বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, ঝড় শুরুর আগেই নদীর পানি ঘরে উঠে গেছে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চরম ভোগান্তি পড়েছেন বলে জানান তিনি। নগরের বেলতলার বাসিন্দা মো. রিপন মিয়া বলেন, পানিতে বসতঘর-রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। হঠাৎ পানি বেড়ে যাওয়ায় জীবন কাটানো কষ্টকর হয়ে গেছে।
নগরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পলাশপুর এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন ও জাহিদুল ইসলাম বলেন, রোববার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে কীর্তনখোলায় উঁচু জোয়ার প্রবাহিত হয়। এই জোয়ারের পানি ফুঁকে পড়ে পলাশপুরে। ফলে এই এলাকার কয়েক শ পরিবারের ঘরদোরে পানি উঠে যায়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বাসিন্দারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের জোয়ার পরিমাপ বিভাগ সূত্র জানায়, বরিশালের কীর্তনখোলা, সুগন্ধা, বিষখালী, বলেশ্বর, হরিণঘাটা, পায়রা, কারখানা, তেঁতুলিয়া, রামনাবাদসহ সব নদ-নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ারে চর, নিম্নাঞ্চল ও লোকালয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে।
বরিশাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম বলেন, বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ১১টি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে বরিশালের বুড়িশ্বর নদীর পানি বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, ঝালকাঠির বিষখালী ২৬ সেন্টিমিটার, ভোলার দৌলতখান উপজেলার সুরমা-মেঘনা নদীর পানি ৬৪ সেন্টিমিটার, তজুমদ্দিনের মেঘনা ১ মিটার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, ভোলার তেঁতুলিয়া ১৪ সেন্টিমিটার, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার বুড়িশ্বর ৩৫ সেন্টিমিটার, বরগুনার আমতলী উপজেলার বুড়িশ্বর নদীর পানি ৩৩ সেন্টিমিটার, বরগুনা সদরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বিষখালী ৬৭ সেন্টিমিটার, পাথরঘাটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত বিষখালী ৭২ সেন্টিমিটার, পিরোজপুরের বলেশ্বর নদের ৩৩ সেন্টিমিটার ও পিরোজপুরের কঁচা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
পাউবো সূত্র জানায়, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জোয়ারে উচ্চতা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে পুরো বিভাগজুড়ে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা উদ্বেগে আছেন লাখো বাসিন্দা।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে বরিশাল থেকে নৌ ও আকাশ পথে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে রোববার সকাল থেকে এই দুই পথে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
বরিশাল বিমান বন্দরের ব্যবস্থাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, রোববার বরিশাল থেকে একটি ফ্লাইট ছিল। আবহাওয়া অনুকূল না থাকায় সেটি বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া বিমানবন্দরে সব বিমান ওঠানামাও স্থগিত করা হয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় ফ্লাইট চালু করা হবে।
বিআইডব্লিউটিএ-এর উপপরিচালক ও বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে।