কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্রসৈকতে গাছের খুঁটিতে নিষিদ্ধ মশারি জাল বেঁধে আহরণ হচ্ছে চিংড়ি পোনা। আজ দুপুরে তোলা
কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্রসৈকতে গাছের খুঁটিতে নিষিদ্ধ মশারি জাল বেঁধে আহরণ হচ্ছে চিংড়ি পোনা। আজ দুপুরে তোলা

কক্সবাজার সৈকতের মশারি জালে প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে দুই কোটি পোনা

৮৪ কিলোমিটার লম্বা কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের পূর্ব পাশে সবুজ পাহাড়-মানুষের ঘরবসতি। পশ্চিম পাশে বঙ্গোপসাগর। দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভ সৈকতে সকাল, বিকেল, সন্ধ্যায় পর্যটকের বিচরণ লেগে থাকে। হাঁটাচলার সময় চোখে পড়ে বালুচরে হাজারো গাছের খুঁটি। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে-বিশাল সৈকতজুড়ে এতগুলো খুঁটি পুঁতে রাখার কারণ কী?

আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা। মেরিন ড্রাইভের টেকনাফ অংশের বাহারছড়া এলাকা। সৈকতের ৫০০ গজ এলাকায় বেশ কিছু গাছের খুঁটিতে বাঁধা নীল রঙের কয়েকটি মশারি জাল। জোয়ারের পানিতে মশারি জাল ডুবে যায় কোমরসমান পানিতে। জালে ঢুকে পড়ে চিংড়ির পোনা, সঙ্গে অন্যান্য প্রজাতির মাছের পোনা ও লার্ভা। পোনা আহরণকারীরা বসে থাকেন কিছুটা দূরে ঝাউবাগানের ভেতর। সময় হলে মশারি জালে আটকে পড়া পোনাগুলো জলভর্তি পাত্রে তুলে নিয়ে চলে যান ঝাউবাগান কিংবা পোনা রাখার ছোট্ট ঘরের ভেতর। তারপর পাত্র থেকে শুধু চিংড়ির পোনা তুলে নিয়ে অন্যান্য মাছের পোনাগুলো বালুচরে নিক্ষেপ করা হয়। তপ্ত রোদে নিক্ষেপ করা পোনাগুলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মারা যায়।

মৎস্য গবেষক, মৎস্য বিভাগ, পোনা ব্যবসায়ী ও পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটার সৈকতে চিংড়ি পোনা আহরণ করেন অন্তত এক লাখ মানুষ। চিংড়ি পোনা বেচাবিক্রি, সরবরাহ ও ব্যবসায় জড়িত আরও অন্তত দুই লাখ মানুষ। প্রতিদিন এ সৈকত থেকেই দৈনিক ৫৫ লাখ চিংড়ি পোনা আহরণ হচ্ছে ১২ হাজার নিষিদ্ধ জালের মাধ্যমে। এসব চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করতে গিয়ে অন্যান্য প্রজাতির আরও ২ কোটি পোনা ধ্বংস করা হচ্ছে।

সমুদ্রবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) চেয়ারম্যান সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার কক্সবাজারের মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। তিনি বলেন, কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে ৪০ হাজারের বেশি নিষিদ্ধ বিহিন্দি, কারেন্ট জাল, ফাঁস জাল পুঁতে রাখা হয়। এসব জালে আটকা পড়ে গভীর সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে আসা মা কাছিমের মৃত্যু যেমন হচ্ছে, তেমনি ডলফিন, হাঙর, জেলিফিশের মৃত্যুও ঘটছে। আবার সৈকতজুড়ে ১০-১২ হাজার মশারি জালে ধরা হয় চিংড়ি পোনা। একটি চিংড়ি পোনা ধরতে গিয়ে অন্যান্য প্রজাতির ৬০-৭০টি মাছের পোনা-লার্ভা ধ্বংস করা হচ্ছে। চিংড়ি পোনা আহরণ বন্ধ করা না গেলে সমুদ্রে মৎস্যভান্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০০১ সালের মৎস্য পোনা আহরণ আইনে সমুদ্র উপকূল থেকে চিংড়ি পোনা আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়।

মশারি জালে ধ্বংস মৎস্যসম্পদ

টেকনাফের জাহাজফুরা সৈকতে ১৫টি খুঁটিতে চারটি মশারি জাল বসিয়ে চিংড়ি পোনা ধরছিলেন স্থানীয় যুবক দিল মোহাম্মদ। আজ ভোর পাঁচটা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত চারটি জালে চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করেন ২ হাজার ৪০০টি। প্রতিটি পোনা বিক্রি করেন ৪০ পয়সা দামে।  সে ক্ষেত্রে তিনি আয় করেন ৯০০ টাকা। কিন্তু ২ হাজার ৪০০ চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি ধ্বংস করেন বিভিন্ন প্রজাতির মাছের অন্তত ৬০ হাজার পোনা।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, নয়াপাড়া, মহেশখালীয়াপাড়া, জাহাজফুরা, বাহারছড়া, শামলাপুর, মনখালী, পাটোয়ারটেক, ইনানি, হিমছড়ি, দরিয়ানগর, কলাতলী সৈকত পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটারজুড়ে অন্তত ৪০ হাজার গাছের খুঁটিতে ১২ হাজার মশারি জাল বেঁধে চিংড়ি পোনা আহরণ হচ্ছে।

জলে ধরা পড়া বাগদা চিংড়ির পোনা। কক্সবাজারে বাগদা চিংড়ির একটি পোনা বিক্রি হচ্ছে ৪০ পয়সায়

আগে লোকজন সমুদ্রের কোমরসমান পানিতে নেমে জাল টেনে চিংড়ি পোনা ধরতেন। পানিতে লোকজনের উপস্থিতি দেখলে মৎস্য বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন অভিযান চালাতেন। জব্দ জাল আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হতো, এখন লোকশূন্য দেখাতে সৈকতে গাছের খুঁটিতে নিষিদ্ধ জাল বেঁধে রাখা হয়। অধিকাংশই ঝাউগাছ।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, সৈকত থেকে গাছের খুঁটিগুলো উচ্ছেদ করা হলে চিংড়ি পোনা নিধনও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা পাবে মৎস্যভান্ডার, জীববৈচিত্র্য ও ঝাউবাগান।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, সৈকতের পোনা আহরণ বন্ধে প্রায় সময় অভিযান চালানো হয়। মশারি জাল পোনাও জব্দ করা হয়। পোনাগুলো সাগরে অবমুক্ত করে মশারি জালগুলো আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। কিন্তু উন্মুক্ত সৈকতে ভোর ও রাতের বেলায় পোনা আহরণ চলে বিধায় তখন অভিযান পরিচালনাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। দপ্তরে জনবল–সংকটও আছে।