শ্রীপুরের ইজ্জতপুর রেলস্টেশনটি ১০ বছর ধরে বন্ধ, ভোগান্তি

সিগন্যাল ঘর, স্টেশনমাস্টারের কক্ষ, বিভিন্ন শ্রেণির যাত্রীদের অপেক্ষাগার, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার ঘরগুলো অবহেলায় পড়ে আছে।

এক দশক ধরে বন্ধ ইজ্জতপুর রেলস্টেশন। ভোগান্তি লাঘবে স্টেশনটি আবার চালুর দাবি স্থানীয়দের। সম্প্রতি গাজীপুরের শ্রীপুরে।

প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষা করতেন শত শত মানুষ। ট্রেনে চড়ে কেউ রাজধানীতে অফিস করতেন। কেউ আবার নিজেদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী ঢাকায় বিক্রি করতে যেতেন। একেকটি ট্রেন থামলেই দেখা যেত উপচেপড়া ভিড়। রেলস্টেশনকেন্দ্রিক আশপাশের দোকানপাটগুলোও থাকত সরগরম। ১০ বছর আগে ঠিক এমনই চিত্র ছিল গাজীপুরের শ্রীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের ইজ্জতপুর রেলস্টেশনের।

একসময়কার ব্যস্ত এই রেলস্টেশনের গল্প বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি জানান, পুরো এলাকা ইজ্জতপুর রেলস্টেশনকে কেন্দ্র করে জমজমাট ছিল। এই রেলস্টেশন হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল ছিল আশপাশের অন্তত ১২টি গ্রামের মানুষের। অথচ স্টেশনটির কার্যক্রম এখন পুরোপুরি বন্ধ। রেলস্টেশনের অবকাঠামোগুলো অবহেলায় পড়ে আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শ্রীপুর ও গাজীপুর সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী ইজ্জতপুর রেলস্টেশনটি ১৯৬৭ সালে চালু হয়। কিন্তু লোকবল-সংকটের কারণ দেখিয়ে ১০ বছর ধরে স্টেশনটি বন্ধ রয়েছে। স্টেশনটি আবার চালু করার জন্য গত তিন বছরে কয়েক দফা মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। চিঠি-চালাচালি করেছেন বিভিন্ন দপ্তরে, কিন্তু সুফল মেলেনি।

রেলস্টেশনের পাশের নলজানি গ্রামের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন বলেন, স্টেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ইজ্জতপুর ও আশপাশে গ্রামের বাসিন্দাদের বিকল্প পথে শহরে যেতে অনেক টাকা খরচ করতে হয়। সময়ও নষ্ট হচ্ছে। ডুয়াইবাড়ী গ্রামের সারোয়ার হোসেন বলেন, স্টেশন চালু থাকার সময় গ্রামের প্রচুর পেশাজীবী মানুষ ট্রেনে করে ঢাকায় অফিস করে সহজে বাড়ি ফিরতে পারতেন। স্টেশন বন্ধ হওয়ায় তাঁদের ব্যয়ও বেড়েছে।

সম্প্রতি ইজ্জতপুর রেলস্টেশনে গিয়ে কথা হয় স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে। তাঁরা জানান, স্টেশনের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ থাকলেও এইট ডাউন নামের একটি মেইল ট্রেন অনানুষ্ঠানিকভাবে সেখানে যাত্রাবিরতি করে। কিন্তু স্টেশনটিতে টিকিটিং ব্যবস্থা না থাকায় এই ট্রেনে ভ্রমণ করলে অন্যান্য স্টেশনে অবৈধ যাত্রী হিসেবে শাস্তির মুখে পড়তে হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০ বছর আগেও স্টেশনটিতে সিক্স ডাউন, এইট ডাউন, ফরটি ফোর ডাউন, অগ্নিবিনা নামের চারটি ট্রেন এখানে দৈনিক আটবার যাত্রাবিরতি দিত। ছিল টিকিট কাউন্টার ও মালামাল বুকিংয়ের সুবিধা। এসব ট্রেনে করে শ্রীপুর ও গাজীপুর সদরের বানিয়ারচালা, দরগারচালা, শিরিরচালা, সিংড়াতলী, চুইঙ্গারচালা, নলজানি, পাটপচা, হালুকাইদ, কাফিলাতলী, বিন্দুবাড়ী, ডুয়াইবাড়ী, মিটালু, মাধবপুরসহ আশপাশের গ্রামের লোকজন এই স্টেশন হয়ে নিয়মিত চলাচল করতেন। প্রতিটি ট্রেনে এই স্টেশন থেকে ১৫০ থেকে ২০০ মানুষ বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করতেন।

রেলস্টেশনের পাশে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান চালান শারীরিক প্রতিবন্ধী মনির হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, স্টেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ইজ্জতপুর ও আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা যোগাযোগব্যবস্থায় বিপাকে পড়ে গেছেন। ‌একসময় এসব গ্রামে উৎপাদিত আম, কাঁঠাল, লিচু, ধানসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য ইজ্জতপুর স্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে বাজারজাত হতো।

সরেজমিনে দেখা যায়, সিগন্যাল ঘর, স্টেশনমাস্টারের কক্ষ, বিভিন্ন শ্রেণির যাত্রীদের অপেক্ষাগার, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার ঘরগুলো অবহেলায় পড়ে আছে। প্ল্যাটফর্মের উন্মুক্ত অংশ ও কংক্রিটের বেঞ্চে ময়লার স্তূপ। প্ল্যাটফর্মের বারান্দায় গরু-ছাগল বেঁধে রেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। রেলস্টেশনের পাশ ঘেঁষে ইজ্জতপুর বাজারটি একেবারেই সুনসান। আশপাশের দোকানপাটগুলো নীরব।

ইজ্জতপুর রেলস্টেশনের বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলীর সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘একেকটি স্টেশন চালু করতে প্রচুর খরচ হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় স্টেশনের সরঞ্জামাদি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বন্ধ স্টেশন চালু করতে ভালো বরাদ্দ দরকার পড়ে। আমরা পর্যায়ক্রমে কিছু বন্ধ রেলস্টেশন চালু করব। ইজ্জতপুর রেলস্টেশনটিও চালু করা হবে।’

স্থানীয় ব্যক্তিদের দাবি, স্টেশনটি চালু করতে গ্রামবাসী কয়েক দফা মানববন্ধন করেছেন। বিভিন্ন দপ্তরে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। বারবার আশ্বাস দিলেও স্টেশনটি চালু হয়নি। ইজ্জতপুর গ্রামের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ইজ্জতপুর ও আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে। স্টেশনটি চালু হলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে, সাধারণ মানুষেরও সুবিধা হবে।