মেলার কারুশিল্প প্রদর্শনী চত্বরে শখের হাঁড়ি দেখছেন ক্রেতা-দর্শনার্থীরা
মেলার কারুশিল্প প্রদর্শনী চত্বরে শখের হাঁড়ি দেখছেন ক্রেতা-দর্শনার্থীরা

মাটির টানে কারুশিল্প মেলায়

প্রতিবারের মতো এবারও সোনারগাঁয়ে নিজেদের কার্যালয় প্রাঙ্গণে মেলার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন।

শৈশবে বাবার হাত ধরে বৈশাখী মেলায় যেতেন ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার নারী উদ্যোক্তা কাজী সারওয়াত জাহান। তাঁর কাছে মেলা মানেই নাগরদোলায় চড়া। বয়স বাড়ার সঙ্গে শৈশবের সেই স্মৃতি ফিকে হয়ে এসেছিল। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে লোক-কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে নাগরদোলা দেখে শৈশবের সেই স্মৃতি মনে পড়েছে তাঁর।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে কারুশিল্প ফাউন্ডেশন (সোনারগাঁ জাদুঘর) চত্বরে দেখা হলো কাজী সারওয়াতের সঙ্গে। গাছের ছায়ায় সবুজ ঘাসের ওপর চাদর পেতে বসেছেন। পাশেই বিশ্রাম নিচ্ছেন সারওয়াতের স্বামী ফাইজুল হাসান চৌধুরী। এই দম্পতির যমজ দুই সন্তান সামিহা ও সানিহা তখন মেলা থেকে কেনা বাঁশের বাঁশিতে সুর তোলার চেষ্টা করছে।

সারওয়াত জানালেন, তাঁর স্বামীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বনভোজনের জন্য ১১ জন মিলে কারুশিল্প মেলায় এসেছেন তাঁরা। মূল উদ্দেশ্য দুই মেয়েকে বাংলার লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ঘোরাফেরা ও কেনাকাটার পাশপাশি মেয়েরা পুতুলনাচ দেখে আনন্দ পেয়েছে। মেলায় এসে উচ্ছ্বসিত এই দম্পতি। জানালেন, প্রত্যাশার চেয়েও ভালো সময় কেটেছে তাঁদের। ফাইজুল বলেন, ‘লোকশিল্পটা আমাদের শিকড়ের কথা বলে। মাটির কথা বলে। বলা চলে, সেই মাটির টানেই মেলায় আসা।’

অদূরেই দেখা গেল কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের লেকের পাশে টেপা পুতুল পুড়িয়ে বিক্রির উপযোগী করছেন রাজশাহীর পবা থেকে আসা শিল্পী সজীব পাল ও তাঁর মা বিজলী রানী পাল। দেশের প্রখ্যাত শিল্পী সুবোধ কুমার পালের সন্তান সজীব। সজীব জানালেন, ছেলেবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে কারুশিল্প মেলায় আসছেন। বাবার অসুস্থতার কারণে এবার তিনি ও তাঁর মা মিলে মেলায় এসেছেন। মেলায় এসে বানানো আগের সব পুতুল বেচা শেষ। এখন মেলার ‘কর্মরত কারুশিল্পী প্রদর্শনী চত্বরে’ বসে বানানো পুতুলগুলো পুড়িয়ে বিক্রির উপযোগী করছেন।

‘কর্মরত কারুশিল্পী প্রদর্শনী’ চত্বরে দেখা গেল, ঝিনাইদহের শোলাশিল্প; রাজশাহীর শখের হাঁড়ি; রংপুরের শতরঞ্জি; সোনারগাঁও, টাঙ্গাইল ও ঠাকুরগাঁয়ের বাঁশ–বেতের কারুশিল্প, ঐতিহ্যবাহী জামদানি, রিকশাচিত্র এবং কিশোরগঞ্জের টেরাকোটা পুতুলের মতো কারুশিল্প তৈরি করছেন শিল্পীরা। মেলায় আগত ক্রেতা–দর্শনার্থীরা সেসব কারুপণ্য তৈরি দেখছেন। পছন্দের সঙ্গে দরে মিলে গেলে কিনে নিচ্ছেন।

তবে খুব কম লোকই এসব কারুপণ্য কিনছেন বলে হতাশা প্রকাশ করলেন কিশোরগঞ্জের নিকলী থেকে মেলায় অংশ নেওয়া খোকন পাল। তিনি বলেন, ‘প্রতিবারের মতো এবারও টেরাকোটা পুতুল নিয়ে মেলায় এসেছি। ক্রেতারা পুতুল হাতে নিয়ে দাম জানতে চান। দাম শোনার পর তাঁরা প্লাস্টিকের পুতুলের সঙ্গে আমাদের পুতুলের মূল্যের তুলনা করে চলে যান। অধিকাংশ ক্রেতাই বুঝতে চায় না, মেশিনে তৈরি প্লাস্টিকের পুতুল আর হাতে তৈরি টেরাকোটা পুতুল এক নয়।’

চত্বরে কথা হলো মেলায় আসা দুই মার্কিন নাগরিক ওয়েফস ও জনের সঙ্গে। জানালেন, মেলায় ঘুরে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন তাঁরা। চড়া রঙের ব্যতিক্রমী ঢঙের কারণে এখানকার রিকশাচিত্র পছন্দ হয়েছে তাঁদের। মেলা থেকে রিকশাচিত্র কিনেছেন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

প্রতিবারের মতো এবারও নিজেদের কার্যালয় (সোনারগাঁ জাদুঘর) প্রাঙ্গণে মেলার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক এ কে এম আজাদ সরকার জানান, মঙ্গলবার প্রায় তিন হাজার দেশি–বিদেশি দর্শনার্থী টিকিট কেটে মেলায় এসেছেন। বিকেলের পর আরও অনেকেই মেলায় এসেছেন। সব মিলিয়ে এবারের মেলা জমে উঠেছে।

কারুশিল্প ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, ১৬ জানুয়ারি মাসব্যাপী লোক–কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব শুরু হয়েছে। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য মেলা চলবে।

এবারের মেলায় ১৭টি জেলার প্রথিতযশা ৬৪ কারুশিল্পী তাঁদের শিল্পকর্ম নিয়ে অংশ নিয়েছেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কারুপণ্যসহ ১০০টি স্টল রয়েছে মেলায়। জনপ্রতি ৫০ টাকা মূল্যের টিকিট কেটে মেলায় প্রবেশ করতে হবে। শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের প্রবেশমূল্য রাখা হচ্ছে ৩০ টাকা। বিকেল পাঁচটার পর কোনো প্রবেশমূল্য লাগবে না।

উৎসবে আগত দর্শনার্থীদের জন্য লোকজ উৎসবে প্রতিদিন বিকেল থেকে জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, লালনগীতি, হাসন রাজার গান, মুর্শিদী গান, চর্যাগান, লোকগল্প বলা, লোকজ নৃত্যসহ বিভিন্ন লোকসাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে।