রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের এক নবীন শিক্ষার্থীকে মানসিক নির্যাতন ও মারধর করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মার্কেটিং বিভাগের দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে গতকাল সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই শিক্ষার্থী।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম মোহাম্মদ রকি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি যে দুই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তাঁরা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী অন্তর বিশ্বাস এবং একই বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান (নাভিল)।
গত রোববার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বিনোদপুরের লেবুবাগান এলাকার ‘বিশ্বাস ম্যানসন’ ছাত্রাবাসে মোহাম্মদ রকি মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও হুমকির শিকার হন। তিনি গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তরে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেন।
অভিযোগপত্রে মোহাম্মদ রকি উল্লেখ করেছেন, ‘আমি মোহাম্মদ রকি রোববার রাত পৌঁনে ১২টা থেকে প্রায় দেড়টা পর্যন্ত মানসিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছি। বিশ্বাস ম্যানসন ছাত্রাবাসের ২০১ ও ২০৫ নম্বর রুমের দুজন শিক্ষার্থী গতকাল রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে আমার কক্ষে আসেন। শুরুতেই তাঁরা আমাকে নানা রকম বিব্রতকর প্রশ্ন করেন। ফলে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হই। কথাবার্তার একপর্যায়ে তাঁরা আমাকে বলেন, “তোকে হলের গেস্টরুমে নিয়ে যাব। গেস্টরুমে নিয়ে গিয়ে তোকে আদর আপ্যায়ন করব। শেষবারের মতো তোর মাকে কল দে, কল দিয়ে বলবি আর কোনো দিন দেখা নাও হতে পারে, আমি কোনো ভুল করলে আমাকে মাফ করে দিও।” একপর্যায়ে তাঁরা আরও বলেন, “আবরার ফাহাদ কে, কীভাবে মারা হয়েছিল, জানিস?” আমি বলি, “জি, ভাই পিটিয়ে মারা হয়েছিল।” তারপর তাঁরা বলেন, “তোকে এভাবে মারলে তখন কী করবি?” তারপর আমি চুপ থাকি।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মোহাম্মদ রকি বলেন, গত শুক্রবার তিনি মেসে উঠেছেন। এর মধ্যে একবার মেসে অবস্থানরত সবার কক্ষে গিয়ে পরিচিত হয়ে এসেছিলেন। এরপর রোববার রাতে ওই দুজন এসে তাঁর কক্ষে এসে নানাভাবে হুমকি ও হয়রানি করেন। ওই রাতে ঘুমাতে পারেননি। এ রকম ঘটনা যেন আর কারো সঙ্গে না ঘটে, সে জন্য তিনি অভিযুক্তদের শাস্তির দাবি জানান।
গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দপ্তরে অভিযোগ দেওয়ার আগে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সঙ্গে উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীবের দেখা হয়। এ সময় ক্যাম্পাসের কর্মরত বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা শুনে তিনি ওই শিক্ষার্থীকে বলেন, ‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমরা আছি। এগুলো আমরা বরদাশত করব না।’
পরে অভিযোগপত্র দেওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর রফিকুল ইসলাম ও নাসির উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তাঁরা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা শোনেন। একপর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে অভিযুক্ত দুজন শিক্ষার্থী ও মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মশিহুর রহমানকে প্রক্টর দপ্তরে ডেকে আনা হয়। পরে অভিযুক্ত দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। উপস্থিত বিভাগের শিক্ষককে এ ব্যাপারে একাডেমিক কমিটির সুপারিশ দ্রুত সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানাতে বলা হয় এবং অভিযুক্ত দুজনকে তাঁর হেফাজতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
গত রোববার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বিনোদপুরের লেবুবাগান এলাকার ‘বিশ্বাস ম্যানসন’ ছাত্রাবাসে মোহাম্মদ রকি মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও হুমকির শিকার হন। তিনি গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তরে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেন।
অভিযোগের ব্যাপারে মার্কেটিং বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান বলেন, ‘আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিভাগের বড় ভাই ওই ছেলের কক্ষে নিয়ে যায়। একপর্যায়ে বড় ভাই রকির সঙ্গে মজা করেন। কিন্তু আমি সেরকম ইনফ্লুয়েন্স করি নাই। মারা বা অত্যাচার করা হয়নি। তবে আবরার ফাহাদের বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বলা হয়েছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং, মারামারি এসব চলে না। এ ধরনের কোনো পরিস্থিতিতে পড়লে আমাদের জানাবি। এরপর আমরা কক্ষ থেকে বের হয়ে যাই। কিন্তু সে বিষয়টা অন্যভাবে নিয়েছে।’
অভিযুক্ত আরেক শিক্ষার্থী অন্তর বিশ্বাস বলেন, ‘তাঁর (রকি) সঙ্গে খুবই সাধারণভাবে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টা সে যেভাবে উপস্থাপন করেছে, সেভাবে হয়নি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তাঁর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করা। কিন্তু ব্যাপারটা এত দূরে চলে যাবে বুঝতে পারিনি। আবরার ফাহাদের বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বলেছি, তাঁর সঙ্গে যেটা ঘটেছে ওটা র্যাগিং; কিন্তু তোমার সঙ্গে যা হচ্ছে এটাকে তুমি র্যাগিং হিসেবে নিও না। তবে মাকে ফোন দেওয়ার বিষয়টা তাঁকে বলা হয়েছে। একটা ফরমাল সম্পর্ক করার জন্য বলেছিলাম।’
ভুক্তভোগীর অভিযোগ ও অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তির তথ্যগুলো আমরা অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বিভাগে পাঠাব। বিভাগীয় একাডেমিক কমিটি একটা সুপারিশমালা তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটিকে জানাবে। সেই অনুযায়ী শৃঙ্খলা কমিটিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।মাহবুবর রহমান, প্রক্টর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। একজন নতুন শিক্ষার্থীকে যেভাবে র্যাগিং দেওয়া হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ শাস্তি যেভাবে নিশ্চিত করা যায়, আমরা সে চেষ্টাই করব।’
মাহবুবর রহমান আরও বলেন, ‘ভুক্তভোগীর অভিযোগ ও অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তির তথ্যগুলো আমরা অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বিভাগে পাঠাব। বিভাগীয় একাডেমিক কমিটি একটা সুপারিশমালা তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটিকে জানাবে। সেই অনুযায়ী শৃঙ্খলা কমিটিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’