রাত পৌনে ৯টার দিকে ডুমুরিয়া থেকে মোটরসাইকেলে খুলনায় আসছিলেন ডুমুরিয়ার শরফপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ রবিউল ইসলাম (৪২)। খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের গুটুদিয়া ওয়াপদা সেতুর কাছে এলে তাঁকে পেছন দিক থেকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। পিঠের নিচে বাঁ পাশে গুলি লাগলে তিনি মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়েন। এরপর হেডলাইট না জ্বালিয়ে মোটরসাইকেলে দ্রুত পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা।
মেহেদী হাসান নামের প্রত্যক্ষদর্শী এক যুবক এসব তথ্য জানান। ঘটনাস্থলের পাশে ব্র্যাক তেলাপিয়া হ্যাচারিতে তিনি চাকরি করেন। ঘটনার সময় তিনি সেতুর পশ্চিম পাশের দোকান থেকে মালামাল কিনে হেঁটে হ্যাচারিতে ফিরছিলেন। তাঁর ঠিক ২০ থেকে ৩০ গজ পেছনে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মহাসড়কে প্রায়ই ছোট-বড় যানবাহনের টায়ার ফাটার ঘটনা ঘটে। এ জন্য এমন শব্দ সাধারণ মানুষকে খুব বেশি আকর্ষণ করে না। শনিবার রাতে সেতু পার হয়ে ২০ গজের মতো সামনে যাওয়ার পর বিকট শব্দ শুনতে পান তিনি। ফিরে দেখেন, মোটরসাইকেল থেকে একজন ছিটকে পড়েছেন। এর পরপরই তাঁরই সামনে দিয়ে আরেকটি মোটরসাইকেল খুলনার দিকে চলে যায়। সেই মোটরসাইকেলে দুজন ছিলেন। কিন্তু তাঁদের মোটরসাইকেলের হেডলাইট জ্বলছিল না। তিনি ভেবেছিলেন, দ্রুতগতিতে যাওয়া মোটরসাইকেলটি হয়তো পড়ে যাওয়া মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দিয়েছে। এ জন্য দ্রুত ছুটে গিয়ে পড়ে যাওয়া ব্যক্তিকে তোলার চেষ্টা করেন। তাঁর চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন।
ওয়াপদা সেতুর উত্তর পাশে গুটুদিয়া কমলপুর নুরানিয়া হাফিজিয়া আশরাফিয়া কওমি মাদ্রাসা। পশ্চিমে কয়েকটি দোকান। ঘটনার সময় দোকানের পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন মো. ফারুক গোলদার। শব্দ শুনে তিনিও মনে করেছিলেন, হয়তো কোনো গাড়ির চাকা ফেটে গেছে। পরক্ষণে মোটরসাইকেল পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পান। দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে দেখেন, একজন পড়ে আছেন। কিছুটা দূরে পড়ে আছে মোটরসাইকেলটিও।
ফারুক গোলদার বলেন, তাঁরা এসে পড়ে থাকা ব্যক্তির হেলমেট খুলতেই চিনতে পারেন। তখন তাঁর জ্ঞান ছিল না। এরপর ওই পথ দিয়ে আসা একটি সিএনজি ভাড়া করে দ্রুত তাঁকে ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠিয়ে দেন তিনি। সিএনজিতে তোলার সময় অন্য আরেকজনের শরীর রক্তে ভিজে যায়। তাঁরা যখন ওই ইউপি চেয়ারম্যানকে হাসপাতালে পাঠান, তখনো বুঝতে পারেননি, তাঁকে গুলি করা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা ভেবেই সব কাজ করেছেন। পরে গুলির ঘটনা জানতে পারেন।
এলাকার আরও কয়েকজন জানান, সাধারণত সব সময় সড়কটিতে ভিড়ভাট্টা লেগে থাকে। রাতের ওই সময় সেখানে যানবাহনের চাপ ছিল না। এ সুযোগেই হয়তো পেছন দিক থেকে চেয়ারম্যানকে গুলি করেছে সন্ত্রাসীরা।
আজ রোববার সকালে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রবিউল ইসলামের ময়নাতদন্ত করা হয়। এ সময় পেটের পেছনের পাশাপাশি জায়গা থেকে পাঁচটি শটগানের গুলি বের করেন চিকিৎসকেরা। গুলি কোনোটি পিঠ ভেদ করে বুকের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায়নি। এ জন্য প্রথম দিকে কেউ বুঝতে পারেনি যে চেয়ারম্যানকে গুলি করা হয়েছে, এমনটা মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
এদিকে রবিউল হত্যার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও কোনো সূত্র খুঁজে পায়নি পুলিশ। এ ঘটনায় আজ রাত আটটা পর্যন্ত ডুমুরিয়া থানায় কোনো মামলাও হয়নি। এ ঘটনায় জড়িত কাউকে আটকও করতে পারেনি পুলিশ।
খুলনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান রাত আটটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ ঘটনায় কেউ এখনো মামলা করেননি। তবে মামলা প্রক্রিয়াধীন।’
ডুমুরিয়ায় গত ৪৫ বছরে সাত ইউপি চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। রবিউলের আগে সর্বশেষ ২০০১ সালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ডুমুরিয়া সদর ইউপির চেয়ারম্যান শেখ কবিরুল ইসলাম নিহত হয়েছিলেন। এরপর কেটে গেছে ২৩ বছর। ২০০৪ সালে গুটুদিয়া ইউপির চেয়ারম্যান খান আলমগীর হোসেন ভারতে বেড়াতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন।
পুলিশ, আওয়ামী লীগ নেতা ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে ডুমুরিয়ায় তৎকালীন খর্নিয়া ইউপির চেয়ারম্যান শেখ মোকছেদ আলীকে প্রথম গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর ১৯৮৬ সালে সদর ইউপির শেখ কামাল উদ্দিন, ১৯৮৯ সালে সদর ইউপির শেখ আবদুল মজিদ, ১৯৯৯ সালে রুদাঘোরা ইউপির তোজাম সরদারকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ২০০১ সালে নিহত কবিরুলের বাবা ছিলেন কামাল উদ্দিন। সর্বশেষ রবিউল ইসলামকে গুলি করে হত্যা করল সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় উপজেলায় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক গোবিন্দ ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকালের ঘটনার পর উপজেলার সাধারণ মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে নতুন করে দুশ্চিন্তা ভর করছে। তবে আমরা বিশ্বাস করি, প্রশাসন ও জনগণ সচেতন থাকলে সন্ত্রাসীরা জনপ্রতিনিধিদের আর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’
রবিউলকে হত্যার মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে বলে মনে করেন ভূমিমন্ত্রী ও খুলনা-৫ আসনের (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একসময় ডুমুরিয়া সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসন ও নেতাদের জোর প্রচেষ্টায় তা বন্ধ হয়ে যায়। ২২-২৩ বছর পর আবার কোনো জনপ্রতিনিধিকে হত্যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে।