গরমে চারদিকে এখন হাঁসফাঁস অবস্থা। এ কারণে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে যখন ‘ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ’-এর আওয়াজ উঠছে, ঠিক সে সময় বৃক্ষনিধনের উৎসবে মেতে উঠেছে কুষ্টিয়ার সামাজিক বন বিভাগ।
নিয়ম রক্ষার নামে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর বাঁধবাজার থেকে মাদুলিয়া পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার সড়কে ১ হাজার ৪৮৫টি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সামাজিক বন বিভাগ। সামাজিক বনায়নের আওতায় ১০ বছর আগে লাগানো গাছগুলোকে কেটে ফেলার জন্য ইতিমধ্যে নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই গাছগুলোকে রক্ষায় পরিবেশবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা সামাজিক বন বিভাগকে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী–খোকসা) আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রউফ সাংবাদিকদের তথ্যের ভিত্তিতে গাছগুলো রক্ষায় দরপত্র স্থগিত করতে বন বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে কুমারখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি গাছ লাগানো শেষে এই নির্দেশনা দেন তিনি। এ সময় সংসদ সদস্য বলেন, ‘প্রচণ্ড দাবদাহ চলছে। নদী-নালা শুকিয়ে গেছে। নলকূপে পানি উঠছে না। সেই মুহূর্তে গাছ কাটার প্রশ্নই ওঠে না। বরং নির্বাচনী এলাকার পরিবেশ রক্ষায় বিপুল পরিমাণে গাছ লাগানো হবে।’
সংসদ সদস্যের সঙ্গে সিভিল সার্জন মো. আকুল উদ্দিন, কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. রাশেদ আল মামুন উপস্থিত ছিলেন।
কুষ্টিয়ার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাশ্যপী বিকাশ চন্দ্র বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক বনায়নের নিয়ম মেনেই গাছগুলো রোপণের ১০ বছর পূরণ হওয়ায় চলতি বছরের ৩ এপ্রিল তা বিক্রির দরপত্র অনুষ্ঠিত হয়। এর এক থেকে দেড় মাস আগে থেকে গাছের নম্বর দেওয়া শুরু হয়।
সংসদ সদস্যের নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দরপত্র স্থগিত করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এই মুহূর্তে দরপত্র স্থগিত করলে আমাকে মামলার মুখোমুখি হতে হবে। তাই করণীয় বিষয়ে জানতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবগত করা হয়েছে। বিভাগীয় নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমারখালীর লাহিনীপাড়া থেকে সান্দিয়ারা পর্যন্ত পাউবোর গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) খাল ঘেঁষে প্রায় ২০ কিলোমিটার পাকা সড়ক রয়েছে। সড়কে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচির আওতায় সমিতির মাধ্যমে প্রায় ১০ বছর পূর্বে কয়েক হাজার ফলদ ও বনজ গাছের চারা রোপণ করে বন বিভাগ। ২০২৩ সালে যদুবয়রা থেকে সান্দিয়ারা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কের আনুমানিক প্রায় ১০ হাজার গাছ দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি ও কাটা হয়। চলতি বছরেও ওই সড়কের লাহিনীপাড়া থেকে বাঁধবাজার পর্যন্ত ১ হাজার ৫৮০টি গাছ কাটা হয়েছে। সর্বশেষ বাঁধবাজার থেকে মাদুলিয়া পর্যন্ত আরও তিন কিলোমিটার সড়কের ১ হাজার ৪৮৫টি গাছ কাটার জন্য গাছের গায়ে নম্বরিং করে দরপত্র সম্পন্ন করেছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
পরিবেশ নিয়ে প্রায় ৪১ বছর ধরে গবেষণামূলক কাজ করছেন গৌতম কুমার রায়। তিনি বলেন, ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী দেশে ২৫ ভাগ বনভূমি বা গাছপালা থাকা দরকার। সেই তুলনায় গাছ আছে মাত্র ৯ ভাগের কম। তবুও প্রতিদিনই গাছ উজাড় হচ্ছে। যে মুহূর্তে প্রচণ্ড তাপদাহ চলছে। পানির মহাসংকট চলছে। গরমে মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা, পাখিকুল আশ্রয় পাচ্ছে না। সেই মুহূর্তে গাছগুলো কাটার ঘটনা সত্যিই অদ্ভুত ও দুঃখজনক।
কলেজছাত্র আলিমুজ্জামান রাজিব বলেন, যেহেতু গাছগুলো আমাদের ছায়া দিচ্ছে। সড়কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে। পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করছে। সেহেতু গাছগুলো না কাটা ভালো। তাঁর ভাষ্য, গাছপালা কমে যাওয়ার কারণেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে না, তীব্র তাপদাহ চলছে। তিনি গাছ না কাটার দাবি জানান।
ভ্যানচালক আবদুল হাকিম জানান, তিনি নিয়মিত ওই সড়ক দিয়ে চলাচল করেন। ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি প্রায়ই সড়কে বসে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেন। গাছগুলো কাটা হলে আর বসা হবে না। তাঁর ভাষ্য, গাছের কারণে মানুষ স্বস্তিতে সড়কে চলাচল করতে পারেন। অনেকেই বিশ্রাম নেন।