পাঁচ বছর আগে শিক্ষক আবদুল কুদ্দুস নিজ অর্থায়নে বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ লাগানো শুরু করেন।
অর্ধচন্দ্রের আদলে সবুজ পাতার (কাঁটামেহেদি গাছের তৈরি) প্রবেশদ্বার। ভেতরে প্রবেশ করতেই ডান দিকে সাজানো-গোছানো সবুজের রাজ্য। কাঁটামেহেদি গাছ দিয়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে শহীদ মিনার, জাতীয় ফুল শাপলা, নৌকা, হেলিকপ্টার, ঘর, বসার আসনসহ কয়েক রকম প্রতিকৃতি। চলতি পথে তা দেখে মুগ্ধ হন পথচারীরা। আসেন ছবি তুলতেও।
দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার ভাবকি ইউনিয়নে ৫১ শতক জমিতে অবস্থিত এ বিদ্যালয়টির নাম সাবেক গুলিয়াড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষকেরা বলেন, ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয় ২০১৩ সালে। বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন পাঁচজন।
আর শিক্ষার্থীসংখ্যা ১০০ জন। পাঁচ বছর আগে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আবদুল কুদ্দুস বিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নিজ অর্থায়নে বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ লাগানো শুরু করেন। বর্তমানে বিদ্যালয়ের সীমানায় ফুল-ফল-ওষুধিসহ প্রায় ৩৫ প্রজাতির গাছ রয়েছে।
বাগানটি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন। ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে স্কুলে আসে। স্কুলে আসার কথা বলতে হয় না।আবদুস সামাদ, অভিভাবক
গত রোববার সকালে বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, মাঠের উত্তরে পাতাবাহারের সারি। যেন রীতিমতো প্রাচীর দেওয়া। লাগোয়া জবা ফুলগাছে ফুটে আছে লাল, সাদা, গোলাপি রঙের জবা ফুল। ফাঁকা মাঠে খয়েরি রঙের পোশাক পরা শিক্ষার্থীরা হইহুল্লোড় করছে। মাঠের পশ্চিমে স্লিপারে ওঠানামায় ব্যস্ত কেউ।
শুধু বিদ্যালয়ের বাইরে নয়, ভেতরটাও অনেক সুন্দর। তিন কক্ষবিশিষ্ট একতলা ভবনের প্রতিটি শ্রেণিকক্ষের দেয়ালে বর্ণমালা ও কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে। শিশুশ্রেণির মেঝেতে বসানো হয়েছে টাইলস। সেখানে বিভিন্ন খেলনাসামগ্রী রয়েছে। পঞ্চম শ্রেণির কক্ষে করা হয়েছে শেখ রাসেল কর্নার। অফিসকক্ষে একটি আলমারিতে আছে বুক কর্নার। বিদ্যালয়ে আছে সততা স্টোরও।
শিক্ষক আবদুল কুদ্দুস জানালেন, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি একজন। শুরু থেকে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির অভ্যন্তরীণ জটিলতার কারণে ধীরে ধীরে কমতে থাকে শিক্ষার্থীসংখ্যা। করোনার প্রকোপের পর তা আরও কমে যায়। এরপর শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন শিক্ষকেরা। তারপর ধীরে ধীরে বিদ্যালয়ের প্রাণ ফিরতে শুরু করে।
শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে ২০১৭ সালে বিদ্যালয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে মনোযোগী হন আবদুল কুদ্দুস। ফুলের বাগান ও ফলের গাছ লাগানো শুরু করেন। বর্তমানে অনেকে বিদ্যালয়ের মাঠ দেখতে আসেন। ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেন। তাঁর এ প্রচেষ্টা কাজে লাগছে। সর্বশেষ পিএসসি পরীক্ষায় শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
আবদুল কুদ্দুস আরও বলেন, প্রায় সব শিক্ষকের বাড়ি বিদ্যালয়ের কাছাকাছি এলাকায়। সপ্তাহে ছুটির দিনগুলোতে যেকোনো একবেলা নিয়মিত বিদ্যালয়ে এসে বাগান পরিচর্যার কাজ করেন তিনি। দা-কাঁচি দিয়ে কাঁটামেহেদির বাড়ন্ত ডালপালা ছেঁটে দিয়ে আদল ঠিক রাখেন। স্কুলে তাঁকে দেখলে আশপাশের শিক্ষার্থীরাও সহযোগিতা করতে চলে আসে।
পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলামিন বলেন, ‘ছুটির পরেও আমরা এখানে (বিদ্যালয়ের মাঠে) খেলাধুলা করি। স্যার যখন বাগানে কাজ করেন, আমরাও থাকি। অনেকেই আসেন, ছবি তুলে চলে যান।’
গুলিয়াড়া গ্রামের আবদুস সামাদ বলেন, স্কুলের বাগানটি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন। এটা দেখে তাঁদেরও ভালো লাগে। ছেলেমেয়েরা আগ্রহ নিয়ে স্কুলে আসে। স্কুলে আসার কথা বলতে হয় না। কয়েক বছর আগেও এমন পরিবেশ ছিল না।
বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক মীনা রাণী মহন্ত বলেন, কয়েক বছর ধরে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীসংখ্যা কম ছিল। বিশেষ করে করোনাকালের পরে বাচ্চাদের বিদ্যালয়ের আসাটা কম হয়ে যায়। এখন আবার শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল কুদ্দুস ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন। একটি আদর্শ বিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা।
খানসামা উপজেলার সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম এ মান্নান বলেন, শিক্ষাকে আনন্দময় এবং বিদ্যালয়কে শিশুর প্রিয় জায়গা হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিবছর বিদ্যালয়গুলোতে যে বরাদ্দ আসে, তা দিয়ে বিদ্যালয়গুলোকে দৃষ্টিনন্দন করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।