বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলায় সান্তাহার রেলস্টেশন। ১০ মাসের শিশুটি কাঁদছিল। স্টেশনের কলার ব্যাপারী আবদুল ওহাব নিঃসন্তান। তিনি শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। ‘বাচ্চা কার গো’ বলে হাঁকডাক দিলেন। কেউ সাড়া দিলেন না। দূরে একজন নারী শুধু দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছিলেন। তাঁর কাছে গিয়ে আবদুল ওহাব বললেন, ‘বাচ্চাটা কি তোমার?’ নারীটি কোনো কথা বললেন না। আবদুল ওহাব বলেন, ‘আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। শিশুটিকে আমি নিয়ে গেলাম। ও যদি তোমার হয়, কোনো দিন মন চাইলে আমার বাড়িতে এসে দেখে যেয়ো।’ এই বলে অচেনা নারীটিকে ঠিকানা দিয়ে আসেন। কিন্তু ওই নারী পরবর্তী সময়ে কোনো দিন ওহাবের বাড়িতে যাননি।
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার আবদুল ওহাবের বাড়িতেই বেড়ে ওঠে শিশুটি। নাম দেওয়া হয় পরিনা। অর্থাৎ পরি নয়—মানুষ। শুধুই ‘পরিনা’; এর আগে–পরে আর কিছুই নেই। পরিনার বয়স এখন ৩৩ বছর। পালক মা-বাবাকে দেখাশোনার জন্য পরিনা বিয়ে–সংসার করেননি। ভেবেছেন, যদি পরের ঘরে গিয়ে মা-বাবাকে দেখাশোনার সুযোগ না পান। তিনি ছাড়া তাঁর মা–বাবার যে আর কেউ নেই! পরিনার পালক মায়ের নাম সাহিদা বেগম। আবদুল ওহাব ২০২২ সালে ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
শৈশব থেকেই নানা চড়াই–উতরাই পাড়ি দিয়ে এ বয়সে পৌঁছেছেন পরিনা। জামালগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। টাকার অভাবে ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। তখন সংসারে অভাব। বয়সের ভারে বাবা আর কলা বিক্রি করতে যেতে পারতেন না। মা প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে চেয়েচিন্তে যা নিয়ে আসতেন, তা খেয়েই কোনো রকমে ক্ষুধা মিটত। কোনো উপায় না দেখে ২০০৯ সালে মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকা বেতনে নাটোরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন পরিনা। চাকরিটি করতে করতেই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দিঘাপতিয়া এম কে কলেজ থেকে ২০১৪ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাজশাহীর নওহাটা ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
২০১৮ সাল পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানেই চাকরি করেন পরিনা। এর মধ্যে সালেহা খাতুন নামের এক সহকর্মীর সঙ্গে তাঁর সখ্য হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সালেহার বাড়ি রাজশাহীর পুঠিয়ার নন্দনপুর গ্রামে। পরিনাকে আপন বোনের মতো ভালোবাসেন। এরপর পরিনার সঙ্গে তিনিও রাজশাহীর নতুন একটি প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরি নিয়েছিলেন। ২০২০ সালে করোনার সময়ে দুজনেই চাকরি হারান। এরপর নানান চেষ্টাও চাকরির ব্যবস্থা হয়নি পরিনার।
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে পরিনা বলেন, ‘সেই দুঃসময়ে আমার পাশে দাঁড়ান সালেহা আপু। তিনি আমাকে টেনশন বাদ দিয়ে পড়াশোনা করতে বললেন। নিজের জমানো টাকায় আমাকে একটি কম্পিউটার কিনে দেন। ঘরে বসে অনলাইনে কিছু কাজ করার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছিলাম না।’
২০২০ সালের ২০ অক্টোবর প্রথম আলোতে ‘কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটাই মা–বাবার ভরসা’ শিরোনামে একটা ফিচার প্রকাশিত হয়। এরপর অনেকের নজরে আসেন পরিনা। দেশ–বিদেশের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী পরিনার পাশে দাঁড়ান। এর মধ্যে ঢাকার সাভার উপজেলার মো. শাহাদাৎ হোসেন খান একজন। তিনি পরিনার মা-বাবার জন্য জয়পুরহাটে পাঁচ শতক জায়গা কিনে দেন। সেখানে পাঁচবিবির উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউএনও সরকারি তহবিল থেকে দালান বাড়ি বানিয়ে দেন। পানির মটর বসানোর ব্যবস্থা করেন।
মানবিক সহায়তায় মাথা গোঁজার স্থায়ী একটি ঠিকানা হয় পরিনার। কিন্তু তিনি প্রায়ই অস্বস্তিতে ভুগতেন। অবশেষে নিজেই সংকল্পবদ্ধ হন ঘুরে দাঁড়ানোর। সিদ্ধান্ত নেন উদ্যোক্তা হবেন। সম্বল বলতে ইচ্ছেশক্তি আর দৃঢ় মনোবল। কয়েক দিন ভাবনাচিন্তার পর অনলাইনে অর্গানিক ফুড সাপ্লাইয়ে কাজ শুরু করেন। ‘পিএস অনলাইন মার্কেট’ নামে ফেসবুকে একটা পেজ খোলেন। কিন্তু সেভাবে সাড়া পাননি। পরবর্তী সময়ে নিজের দুটি ফেসবুক আইডি থেকেই ব্যবসার কাজ শুরু করেন। ২০২১ সালে প্রথমবার আমের মৌসুমে বাগান থেকে লাইভ করেন। সাড়াও পান বেশ। সরাসরি বাগান থেকে আম তুলে কুরিয়ারের মাধ্যমে বাংলাদেশের যেকোনো জেলায় বিক্রি শুরু করলেন।
পরিনা বলেন, ‘সেবার আমের মৌসুমে বেশ ভালো আয় করলাম। এরই ফাঁকে বিভিন্ন গাছের চারাও অনলাইনে বিক্রি শুরু করি। আমের সিজন শেষ হলে শীতকালে খাঁটি খেজুর গুড়ের পাশাপাশি খাঁটি ঘি ও চাষের খাঁটি মধু বিক্রি করতে থাকি।’ মাঝেমধ্যে নিজেই পণ্য ডেলিভারির কাজ করেন পরিনা। তিনি বলেন, ‘গ্রামের মাটির রাস্তায় ভ্যান না পেলে পাকা রাস্তা পর্যন্ত নিজে সাইকেল চালিয়ে গ্রাহকদের অর্ডার করা পণ্য নিয়ে যাই। বৃষ্টির দিনে রেইনকোট পরে নিজে ভ্যান ঠেলে আম নিয়ে গেছি কুরিয়ার করতে…।’
অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে পরিনা বলেন, ‘একটা সময় আমার জন্ম–ঠিকানা ইত্যাদি দুঃখ থাকলেও এখন তা নেই। বর্তমানে আমি, আমার বৃদ্ধ মা ও সালেহা আপু থাকছি একসঙ্গে। আমার গর্ভধারিণী মা যে–ই হোক না কেন, তাঁর প্রতিও আমার কোনো রাগ নেই। কারণ, আমি নিজে চলতে গিয়ে প্রতি ধাপে ধাপে বুঝতে পারছি, মেয়েদের এই সমাজে নিজের পায়ে দাঁড়ানো কতটা কঠিন।’
বর্তমানে অনলাইনে ব্যবসা করে পরিনা মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করেন। এ আয়ে অবদান রেখেছে ইন্টারনেট। যার কল্যাণেই এখন রাজশাহীর গণ্ডি পেরিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে গেছে পরিনার ব্যবসা। হয়েছেন তিনি স্বনির্ভর। পরিনার মতো এমন অসংখ্য গ্রামীণ নারী ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ ও অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন। তাঁদের জীবনে ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহার শেখাতে সারা দেশের দুই হাজার ইউনিয়নে চলছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ শীর্ষক আয়োজন।
গ্রামীণফোনের উদ্যোগে আয়োজিত উঠান বৈঠক কার্যক্রমের সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় গত বৃহস্পতিবার (০৫ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ১ হাজার ৯৬৯টি ইউনিয়নে উঠান বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে।