ইলিশের ভরা মৌসুমে গভীর সাগরেও খুব বেশি ইলিশ মিলছে না। দু-একজন ভাগ্যবান ট্রলারমালিক বেশি ইলিশ পেলেও অধিকাংশ ট্রলারের জেলেরা আশানুরূপ ইলিশ না পেয়ে ফিরে আসছেন। বাজারে ইলিশের প্রাপ্যতা কম থাকায় দামও আকাশচুম্বী। ফলে এবার জাতীয় মাছটির নাগাল পাচ্ছেন না নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা।
জেলেদের ভাষ্য, সাগরে ছিটেফোঁটা যে ইলিশ ধরা পড়ছে, এর বেশির ভাগই জাটকা আকৃতির। বড় ইলিশের সংখ্যা কম। ভাগ্যক্রমে দু-একটি ট্রলারে অস্বাভাবিক পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়লেও অধিকাংশ ট্রলারেই কাঙ্ক্ষিত ইলিশ মিলছে না। দু-একটি ট্রলারে অস্বাভাবিক বেশি ইলিশ পাওয়ার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ায় উচ্চ দাম নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে ক্ষোভও দেখা দিয়েছে। আসলে ইলিশের আহরণের প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। আহরণ কম হওয়ায় বাজারে দাম কমছে না।
প্রায় এক দশকে ভালো ব্যবস্থাপনার কারণ দেশে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বিশ্বে মোট ইলিশের ৮০ শতাংশ বাংলাদেশে আহরণ হয়। ফলে বাংলাদেশ ১ নম্বর ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের স্বীকৃতি পায়। কিন্তু এবার সাগর ও নদীতে ইলিশের আকালের পেছনে কারণ কী থাকতে পারে, তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
পাথরঘাটার এফবি বিসমিল্লাহ নামে একটি ট্রলারের মালিক সিদ্দিক জমাদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর ইলিশ মৌসুমের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত চারবার সাগরে ট্রিপ দিয়েছেন। প্রতিবার গড়ে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রতিবারে ইলিশ ও মিশ্র যে মাছ পেয়েছেন, তা গড়ে বিক্রি করেছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকায়। এতে প্রতি ট্রিপে লোকসান হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া দুই-একটি ট্রলারমালিক চলতি মৌসুমে ১২ থেকে ১৬ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করলেও তাঁদের আগের ট্রিপগুলোতে বেশ লোকসান হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, সাগরে দু-একটি ট্রলারে অস্বাভাবিক ইলিশ পাওয়াকে ইলিশের ভালো মজুতকে নির্দেশ করে না। এটা ব্যতিক্রম, কিন্তু অধিকাংশ ট্রলারের জেলেরা যখন ইলিশ পান না, নদীতে যখন ইলিশ আসে না এবং ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম আকাশচুম্বী, তখন এই পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন। অনিয়ন্ত্রিত জাটকা নিধন, নদ-নদীর মোহনায় জাল পেতে ইলিশ আসতে বাধা দেওয়া, সাগর মোহনায় পরিবেশঘাতী উন্নয়নের কারণে ইলিশ আকালের কারণ হতে পারে।
কক্সবাজার উপকূলে ইলিশের প্রাপ্যতা ১৫ দিন ধরে বাড়লেও দক্ষিণ উপকূল ও গভীর সাগরে ইলিশ ধরা পড়ছে কম। কক্সবাজারে গত ১৫ দিনে বিভিন্ন মৎস্যকেন্দ্র থেকে ৪ হাজার ৮০০ মেট্রিক টনের বেশি ইলিশ সারা দেশে সরবরাহ করা হলেও বাজারে দাম কমছে না। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য বন্দর পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে আগস্টের ৩০ দিনে ইলিশ এসেছে মাত্র ২৭০ দশমিক ৫ মেট্রিক টন। এ ছাড়া বরিশাল পোর্ট রোডের অবতরণ কেন্দ্রে গতকাল বুধবার মাত্র ১০০ মণ ইলিশ এসেছে। এসব ইলিশ নদীর নয় সাগরের।
প্রায় এক দশকে ভালো ব্যবস্থাপনার কারণে দেশে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। বিশ্বে মোট ইলিশের ৮০ শতাংশ বাংলাদেশে আহরণ হয়। ফলে বাংলাদেশ ১ নম্বর ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের স্বীকৃতি পায়। কিন্তু এবার সাগর ও নদীতে ইলিশের আকালের পেছনে কারণ কী থাকতে পারে, তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এবার ইলিশ পেতে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। সেপ্টেম্বরের অমাবস্যা-পূর্ণিমায় ইলিশ আসবে। গত মৌসুমে ৫২ শতাংশ মা মাছ ডিম ছেড়েছে। এতে ৪০ হাজার কোটি জাটকা যোগ হওয়ার কথা। চুরি করে ধরে নেওয়ার পর ৫০ শতাংশও যদি টিকে থাকে, তাহলে ইলিশের মজুতে ঘাটতি হওয়ার কথা নয়।
পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের গহরপুর গ্রামের এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের বাদল মোল্লা বলেন, সাগরে তেমন মাছ না থাকায় বাজারে মাছের দাম বেশ চড়া। ১ কেজি ওজনের ইলিশ মাছের মণ বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৯২ হাজার টাকা। আর ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের মণ বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা। জাটকা (৫টায় এক কেজি) বিক্রি হয়েছে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা মণ। এ সময়ে মাছের এমন দাম শুধু অস্বাভাবিকই নয়, অকল্পনীয়।
বরিশাল পোর্টরোড অবতরণ কেন্দ্রের পাইকার সমিতির সভাপতি আশরাফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল এখানে মাত্র ১০০ মণ সাগরের ইলিশ এসেছে। দাম পাইকারি বাজারে আকাশছোঁয়া। ৭০০ গ্রাম থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মণ বিক্রি হয়েছে ৫৪ হাজার টাকা। এক কেজির ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৬১ হাজার টাকা মণ। এক কেজির ওপরের ইলিশ মণ বিক্রি হয়েছে ৬৭ হাজার টাকা। এবার ইলিশের যে অবস্থা, তাতে তাঁরা খুবই হতাশ।
নিষিদ্ধ জালে বাধা পাচ্ছে ইলিশ
নদ-নদীতে ইলিশ না পাওয়ার পেছনে জেলে ও মৎস্য বিশেষজ্ঞেরা কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলছেন, দক্ষিণের নদীগুলো বরগুনার পায়রা, বিষখালী, বলেশ্বর এবং ভোলার তেঁতুলিয়া, বুড়াগৌরাঙ্গ হয়ে মেঘনা অববাহিকা থেকে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। মোহনার এসব অংশে বেহুন্দি, ভাসা, খুঁটা জাল দিয়ে সারা বছর ঘিরে রাখায় এখানে নির্বিচারে ইলিশের পোনাসহ সব ধরনের মাছের পোনা আটকা পড়ে। জাল দিয়ে ঘিরে রাখায় এই মোহনার পুরো অংশে কয়েক শ কিলোমিটারজুড়ে ডুবোচর পড়ে গেছে। একই সঙ্গে সুন্দরবন ও সাগর মোহনায় বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকারের ফলে জাটকাসহ বিপুল মাছ এই ফাঁদ থেকে বেঁচে ফিরলেও সাগরে গিয়ে বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে। এসব কারণে নদীতে ইলিশ ঢুকতে পারছে না এবং সাগরেও গতিপথ পাল্টে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচারক মো. আনিছুর রহমান তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, এসব জালের কারণে ইলিশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে এটা সত্য। একইভাবে নদীদূষণ, নাব্য হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট আবহাওয়া পরিবর্তন এসব কারণ জড়িয়ে আছে। তাঁরা চেষ্টা করছেন, মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যাগুলো নিরসের। তবে ইলিশের মজুত নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
চাঁদপুরের কান্ট্রি ফিশিংবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি শাহ আলম মল্লিক বলেন, সাগর ও নদীতে এবার ইলিশ কম হওয়ার পেছনে সাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞাও একটি বড় কারণ। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় এই নিষেধাজ্ঞা থাকে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ৬৫ দিন। আর ভারতের জলসীমায় তা থাকে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত ৬১ দিন। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে প্রায় ৩৯ দিন ভারতীয় জেলেরা এ দেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ ধরেন। একই সময়ে দুই দেশের সমুদ্রসীমায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে ইলিশ আহরণে এমন নেতিবাচক প্রভাব পড়ত না।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ ও অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান মৎস্য গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, নানা কারণে ইলিশের মজুতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এখন এটা অনেকটাই নিশ্চিত করে বলা যায়। ইলিশ আহরণের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তার সঙ্গে মাঠের তথ্যের বিস্তর গরমিল দেখা যাচ্ছে। সাগর মোহনায় ক্ষতিকর শিল্প স্থাপন, অনিয়ন্ত্রিত জাটকা নিধন, ছোট ফাঁসের জালের অবাধ ব্যবহার ইলিশ সম্পদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে জনসচেতনতা তৈরি এবং বাস্তবমুখী ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রণয়ন করা এখন খুবই জরুরি। না হয় অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।